ইতিহাস শিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হল শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা পদ্ধতি (Discussion Method)। সাধারণত পারস্পরিক মত বিনিময় বা কথোপকথনকেই আলোচনা বলে। যে পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নির্দেশক্রমে পাঠ্যবিষয়ে কোনো সমস্যা দলীয়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোবার চেষ্টা করে তার নাম (শ্রেণি আলোচনা Class Discussion) আলোচনা পদ্ধতি।
আলোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য (Features)
আলোচনা পদ্ধতিতে একটি সুস্থ বিদ্যালয় পরিবেশে শিক্ষার্থীকে পাঠ আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। আলোচনায় সকলের অভিমতকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গণতান্ত্রিক আদর্শকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বস্তুতপক্ষে, শিক্ষার্থী কোনো কিছু শেখে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, ভাবের আদানপ্রদানে, কথাবার্তায়, তর্ক-বিতর্কে, কৌতূহলী জিজ্ঞাসার উত্তরদানে।
আলোচনা পদ্ধতির শ্রেণীবিভাগ (Types)
আলোচনা পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে—(১) সমষ্টিগত ঘরোয়া আলোচনা (Informal Group Discussion), (২) সমষ্টিগত নিয়মমাফিক আলোচনা (Formal Group Discussion), (৩) প্যানেল আলোচনা (Panel Discussion), (৪) বিতর্ক (Debate), (৫) সিমপোজিয়ম (Symposium), (৬) সেমিনার (Seminar), (৭) গোলটেবিল বৈঠক (Round Table Conference) প্রভৃতি।
আলোচনা পদ্ধতির প্রয়োগ (Application)
আলোচনা পদ্ধতিকে সার্থক করে তুলতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসরণ বাঞ্ছনীয়। পরিকল্পিত আলোচনায় 3 টি স্তর বা অংশ থাকে। যেমন- (১) প্রস্তুতি, (২) আলোচনা এবং (৩) মূল্যায়ন।
প্রস্তুতি পর্ব
আলোচনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উভয়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন হলেও শিক্ষার্থীদের সঠিক লক্ষ্যে পরিচালিত করতে সর্বাগ্রে শিক্ষকের প্রস্তুতি প্রয়োজন। আলোচনার জন্য শিক্ষককে পাঠ-পরিকল্পনা, শ্রেণি ব্যবস্থাপনা (Class arrangement), শিক্ষণ প্রসঙ্গে মূল উপাদান (Source), পাঠ্যপুস্তক, পত্রপত্রিকা, জীবনী বৃত্তান্ত এবং Simple Monography পাঠ ইত্যাদির প্রস্তুতি প্রয়োজন। এই ধরনের প্রস্তুতিতে পূর্বসংস্কার কিংবা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে উঠে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন প্রয়োজন।
আলোচনা পর্ব
আলোচনা পর্বে শ্রেণিশৃঙ্খলা, স্বাধীন ও যুক্তিপূর্ণ চিন্তার আদানপ্রদানের সমসুযোগ, পরমত সহিষ্ণুতা, আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য শর্ত। আলোচনার সময় পাঠ্যবিষয়ের তথ্য, সংশ্লিষ্ট চার্ট, ম্যাপ, চিত্র ও আলোচনার সময়তালিকা অনুসরণ করতে হয়।
মূল্যায়ন পর্ব
আলোচ্য বিষয়বস্তুর মূল্যায়ন ত্রিধারায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রথমত, ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জ্ঞান পরীক্ষা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর ইতিহাস চিন্তা বিজ্ঞানভিত্তিক ও নৈব্যত্তিক হল কিনা। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জানবার কৌতূহল, উদারতা, সহিষ্ণুতা ও আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যবোধ জাগরিত হল কিনা তার পরীক্ষা। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত কর্মের মূল্যায়ন। এইভাবে পাঠ পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সুদীর্ঘ মূল্যায়ন প্রয়োজন হয়।
আলোচনা পদ্ধতির সুবিধা (Merits)
(১) শিক্ষার্থীর চিন্তার উৎকর্ষ সাধিত হয়। স্বাধীনভাবে আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। তারা স্বশিখনে অনুপ্রাণিত হয়।
(২) একে অন্যের যুক্তি শুনে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। আলোচনার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
(৩) শিক্ষার্থীর ভুল ধারণা সংশোধিত হয়।
(৪) একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। দলবদ্ধ আলোচনা সঠিকভাবে সংগঠিত হলে তা শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে সক্রিয় করে তোলে।
(৫) আলোচনা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বদানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
(৬) শিক্ষকের পরিচালনায় আলোচনাসভায় লাজুক শিক্ষার্থীরাও লজ্জা-সংকোচ কাটিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জড়তামুক্ত হতে পারে।
আলোচনা পদ্ধতির অসুবিধা (Demerits)
(১) আলোচনা পদ্ধতিতে আলোচনা একটি সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় ইতিহাস শিক্ষকের পক্ষে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভবপর হয় না।
(২) আলোচনা পদ্ধতিতে পাঠ-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর সময় প্রয়োজন হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠ্যসূচি শেষ করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।
(৩) শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি হলে অনেক সময় শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হত।
(৪) অনেক সময় দক্ষ শিক্ষকের অভাব আলোচনা পদ্ধতিতে সুষ্ঠুভাবে বিষয় উপস্থাপনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
(৫) আলোচনা পদ্ধতি ব্যয়বহুল, কারণ ইতিহাসের পৃথক কক্ষ, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি ও শিক্ষোপকরণের প্রয়োজন হয়।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, আলোচনা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি বসে সরাসরি আলোচনার সুযোগ লাভ করে। স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এসময় কোনো মতভেদ দেখা দিলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সাহায্য নিতে পারে। দলগত কাজের শেষে শিক্ষার্থীরা প্রতিবেদন তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। বিভিন্ন দলের উপস্থাপিত প্রতিবেদনের ওপর আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত সমস্যাটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা, সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা, পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি গুণাবলি বিকশিত হয়। তবে এ পদ্ধতি উচ্চতর শ্রেণিতে অধিক ফলপ্রসূ।