বিদেশী পর্যটক নিকোলো কন্টি, পায়েজ, নুনিজ, আবদুর রজ্জাক, এডোয়ার্ড বারবোসা, নিকিতন প্রমুখের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়। বিজয়নগর ছিল সমকালীন বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য। পর্যটকদের মধ্যে অনেকেই বিজয়নগরের অতুল ঐশ্বর্য দেখে চমকিত হয়েছেন। অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের মূলে ছিল কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি। কৃষি ছিল জনসাধারণের প্রধান জীবিকা। কৃষির জন্য জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল। বিজয়নগর রাজ্য জমির মালিকানা জমিদার, মঠ ও মন্দিরগুলির হাতে চলে যায় এবং কৃষকেরা তাদের মজুরে পরিণত হয়। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে ছিল ধান, গম, বার্লি, মশলা, যব, কলাই ও তুলাজাত দ্রব্যাদি। মঠ ও মন্দির কর্তৃপক্ষ সুদের বিনিময়ে কৃষকদের ঋণ দিত। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমি বাজেয়াপ্ত করা হত।
শিল্পোৎপাদনের দিক থেকে বস্ত্রশিল্প, যন্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতু ও খনিজ উৎপাদন প্রধান ছিল। আবদুর রজ্জাক ও পায়েজের রচনা থেকে জানা যায় যে, শিল্পী ও বণিকদের পৃথক পৃথক সংঘ বা গিল্ড ছিল এবং এই সংঘগুলি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। আবদুর রজ্জাক-এর মতে, বিজয়নগরে তিনশো বন্দর ছিল। মালাবার উপকূলে ব্যস্ততম বন্দর ছিল কালিকট। পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, মালয়, উপদ্বীপ, চীন, আরব, পারস্য, দক্ষিণ-আফ্রিকা, আবিসিনিয়া, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশের সাথে বিজয়নগরের বাহির্বাণিজ্য চলত। বারবোসা-র রচনা থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আমদানি-রপ্তানির কথা জানা যায়। বিজয়নগর থেকে রপ্তানি হত চাল, লোহা, গন্ধক, চিনি, মশলা ও কাপড় এবং আমদানি হত আরবি ঘোড়ার, হাতি, মুক্তা, তামা, প্রবাল, পারদ ও রেশমবস্ত্র। বহির্বাণিজ্য থেকে বিজয়নগরের প্রচুর সম্পদ আহরিত হয়। জলপথ ও স্থলপথে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলত। স্থলপথে ঘোড়া, বলদ ও গো-শকটে মাল পরিবহন হত। সমুদ্রের উপকূলবর্তী বন্দরগুলিও অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যে ব্যবহৃত হত। বিজয়নগরে বড়ো জাহাজ তৈরি হত। বারবোসা-র লেখা থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের মালদ্বীপে বড়ো জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল।
বিজয়নগরে সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল। মুদ্রায় দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃাত আঁকা থাকত। ভূমিরাজস্ব ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমিকর হিসেবে আদায় করা হত। এছাড়া প্রজাদের সম্পদ-কর, বিক্রয়-কর, যুদ্ধকর, বিবাহ-কর, আদালত-কর, মন্দিরকে প্রদেয় কর প্রভৃতি নানা ধরনের কর দিতে হত।
দেশের অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল এবং তাঁদের জীবন বিলাস-বৈভবে পূর্ণ ছিল। অপরপক্ষে, সমাজে ধনবন্টন না থাকায় ও জাতিভেদ প্রথার জন্য সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা কারিগর শ্রেণি তাদের পরিশ্রমের ফল ভোগ করতে পারত না। সাধারণ মানুষের জীবন করভারে জর্জরিত ছিল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল অতি সাধারণ। জমির মালিকানা কৃষকদের হাত থেকে জমিদার ও সামন্ত প্রভুদের হাতে চলে যায় এবং সাধারণ কৃষক একপ্রকার ভূমিদাসে পরিণত হয়। বিদেশি পর্যটকদের রচনা থেকে জানা যায় যে, বিজয়নগর শহরের বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম ছিল সস্তা এবং শহরে সর্বদাই খাদ্যদ্রব্য মজুত থাকত। অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণির জীবন ছিল দুর্বিষহ। নুনিজ ও পায়েজ উল্লেখ করেন যে, ক্ষুধার জ্বালায় দরিদ্র মানুষ ইঁদুর, বিড়াল ও টিকটিকি ভক্ষণ করত।