টোকুগাওয়া শোগুন যুগে জাপানের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। ধান ছিল গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজ পণ্য। জাপানে অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতিতে ধান চাষ করা হত। টোকুগাওয়া জাপানে সম্পদের প্রধান উৎস ছিল জমি। জাপানের কৃষকেরা ধান চাষ ছাড়াও নীল, শন, তুলা, লাক্ষা ও তুঁত প্রভৃতি চাষ করত। শোগুন যুগে জাপানে কৃষিভিত্তিক প্রায় স্ব-নির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। গ্রামের মানুষেরা কেবলমাত্র লবণ, তেল এবং ধাতব দ্রব্য গ্রামের বাইরে থেকে আনতেন।
গ্রামাঞ্চলে কৃষকেরা অবসরকালীন ঋতুতে নানা ধরনের কুটির শিল্পে নিযুক্ত থাকতেন। ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে শিল্পজাত পণ্য ক্রয় করে বাণিজ্যের জন্য নিয়ে যেতেন। গ্রামীণ কারিগরেরা ‘শিল্পী সংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন। টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের যুগে জাপান নিজেকে বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এর অনিবার্য ফল ছিল বিদেশী বাণিজ্যের দ্রুত অবনতি। সুতরাং বিদেশী বাজার লুপ্ত হবার ফলে জাপানের শিল্প টোকুগাওয়া যুগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শিল্পের অগ্রগতি রুদ্ধ হবার ফলে অষ্টাদশ শতকের অন্তিমলগ্ন থেকে জাপান এক অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ জি. সি. অ্যালেন, এই আর্থিক সংকটকে টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের কারণ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়ে ওঠে এবং জাপানের সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু এই সময় থেকেই জাপানে ব্যবসা-বাণিজ্যের পুনরুত্থান ঘটতে আরম্ভ করে। তবে বাণিজ্যিক উন্নতির মূলে ছিল কৃষি। ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই জাপানে নয়া পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করা শুরু হয়েছিল। কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলশ্রুতি হিসাবে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধান উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবার ফলে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করে তা বিক্রি করতে শুরু করেন। জাপানে কৃষির বাণিজ্যকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল জাপানী বণিকদের উদ্যোগে। কৃষির বাণিজ্যকরণের ফলে জাপানী ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর মুনাফা এসেছিল, তা তাঁরা শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। ফলে শহরাঞ্চলে ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকেরা দারিদ্র্যের চাপে গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে আসত শুরু করেন। ধান ছিল জাপানের বিনিময়ের একক। কিন্তু শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে জাপানে মুদ্রা-অর্থনীতি প্রচলন ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবার ফলে রেশম ও সুতিবস্ত্র, আসবাবপত্র এবং ধাতব পদার্থের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জাপানের শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতি অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল।
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে জাপানে নয়া বাণিজ্যিক শ্রেণীর (Neo Commercial Class) উত্থান ঘটে। ঐতিহাসিক ন্যাথানিয়েল পেফার (Nathaniel Peffer) এই শ্রেণীকে “ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সমার্থক” (Equivalent to European Bourgeoisie) বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সময় থেকে নয়া বণিক শ্রেণী জাপানের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। এই সময়ে একদল বণিক শহরে অর্থনীতির উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। এদের বলা হত “চোনিন” (Chonin)। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নতির জন্য “চোনিন” বণিক শ্রেণি উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছিলেন। এই বণিকরা কৃষকদের থেকে ও গ্রামীণ শিল্পী ও শহুরে কারিগরদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে, সেগুলি বিক্রি করার ব্যবস্থা করতেন। স্থানীয় শিল্পী ও কারিগরদের বণিকেরা কাঁচামাল সরবরাহ করার দায়িত্বও গ্রহণ করতেন। তাছাড়া তাঁরা নানা ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলী এবং ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দ্রব্য কিনে এনে এক জায়গায় জমা করে রাখার জন্য বড় বড় গুদাম ঘর (Warehouse) নির্মাণ করেছিলেন। যেসব অঞ্চলে গুদাম ঘর নির্মিত হয়েছিল, সেইসব অঞ্চল বাজার বা গঞ্জে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া এই বণিক শ্রেণী আধুনিক অর্থনীতিতে সুপরিচিত নানা ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, যথা—হুন্ডি দেওয়া, ঋণ দিয়ে উৎপাদকদের সাহায্য করা, প্রতিজ্ঞাসূচক মুদ্রা বাজারে ছাড়া প্রভৃতি কাজের সাথে যুক্ত থাকত। এই নয়া-বাণিজ্যিক শ্রেণীর উদ্যোগে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ইয়েডো, ওসাকা প্রভৃতি শহর বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।