মানুষ সামাজিক জীব, সমাজবদ্ধতাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর মানবশিশু সমাজের গৃহ-পরিবারের এক অমূল্য সজীব সত্তাবিশেষ। তাই শিশুশিক্ষার পরোক্ষ মাধ্যম হিসেবে গৃহ বা পরিবারকে অস্বীকার করা যায় না। বলাই বাহুল্য প্রাথমিক জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য গৃহ বা পরিবারের দান সত্যই অপরিসীম।
শিক্ষায় গৃহ, বিদ্যালয় ও সমাজের যৌথ ভূমিকাঃ
গৃহ-পরিবেশ থেকে শিশুরা সর্বপ্রথম বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের সাথে পরিচিত হয় এবং সমাজজীবনের বিভিন্ন রীতিনীতি ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকে। শিশুদের সাথে গৃহের সম্পর্ক মূলত ছোট পাখিদের সাথে নীড়ের সম্পর্কের মতনই।
অনেক শিক্ষাবিদের অভিমত যে শিশুদের মধ্যে যা কিছু মধুময়, মঙ্গলময় ও সত্যধর্মী সম্ভাবনা থাকে তাকে বিকশিত করে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে গৃহ বা পরিবারের। এর থেকে এটুকু স্পষ্টই বোঝা যায় যে শিশুদের জীবনের প্রাথমিক আচরণধারার সুস্থ বিকাশে গৃহের বা পরিবারের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
এমনিভাবেই বলা যায় যে গৃহ-পরিবার যেমন মানব শিশুর শিক্ষার প্রথম পথপ্রদর্শক তেমনি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সুষম ও সর্বোত্তম বিকাশে বিদ্যালয় ও সমাজের অবদানও কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। মানবশিশুকে সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে উঠতে হয়, তাই আমাদের যা কিছু সুন্দর ও কল্যাণকর তা-ই তার কাম্য ও বাঞ্ছিত বস্তু হয়ে ওঠে। কিন্তু সমাজের যা কিছু সুন্দর, কল্যাণকর ও মঙ্গলময় তাকে পেতে হলে প্রত্যেক শিশুকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং কাম্য ও বাঞ্ছিত আচরণধারা প্রদর্শন করে জীবনকে লক্ষ্যভিত্তিক পথে সর্বোত্তমরূপে ও সম্পূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে হবে।
বস্তুত এই শিক্ষা দেওয়ার কাজে সমাজ তার অসংখ্য অসংগঠিত মাধ্যমসমূহের দ্বারা বিভিন্ন কারণে সুশৃঙ্খল উপায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে সৃষ্টি করেছে প্রথাগত শিক্ষামাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়কে। এমনিভাবেই বিদ্যালয় শিক্ষার ধারক ও বাহক। বলা বাহুল্য যে এই বিদ্যালয় সমাজেরই প্রতিকৃতি। একটা ক্ষুদ্র সমাজের চিত্র বিদ্যালয়ে ফুটে ওঠে। তাই বিদ্যালয়কে বলা হয় ‘সমাজের প্রতিচ্ছবি’।
শিক্ষাবিদ রাসেল বার বার বলেছেন যে গৃহ-পরিবার শিশুশিক্ষার বাহক হলেও বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় আধুনিক গৃহগুলোর অবিন্যস্ত পরিবেশের দ্বারা শিশুদের আচরণধারায় কাম্য ও বাঞ্ছিত পরিবর্তন এবং পরিমার্জন আনা কখনই সম্ভব নয়। আর সেজন্যই গৃহের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গৃহের বিকল্প হিসেবেই সমাজের প্রয়োজনে ও পরামর্শে বিদ্যালয়কে শিশুশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
বস্তুত শিশুদের জীবন বিকাশের উপযোগী আলো-জল-বাতাস, খেলার মাঠ, স্বাধীন বিচরণের জন্য উন্মুক্ত প্রান্তর ও সুষম খাদ্য ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো আধুনিক গৃহ-পরিবেশে প্রায়ই দেখা যায় না। অবশ্য তার বেশিরভাগ কারণই হচ্ছে অর্থাভাব।
এজন্যই আধুনিক শিক্ষাবিদরা শিশুশিক্ষায় গৃহ-পরিবেশের পরিপূরক বিধিবদ্ধ মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়কেই ভেবেছেন। অবশ্যই এই বিদ্যালয়গুলোতে উপযুক্ত শিক্ষা প্রসারের স্বার্থে যে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের স্নেহচ্ছায়া থাকতেই হবে সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত মত দিয়েছেন।
শিক্ষাবিদ জন ডিউই-ও পরিবারের সাথে বিদ্যালয়ের যথার্থ সংযোগসাধনের উপযোগিতাকে মূর্ত করে তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ব্রাউন (Brown) বলেছেন যে বিদ্যালয়কে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ মাধ্যম হিসেবে গৃহ-পরিবেশের সাথে সার্থক সম্পর্ক স্থাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এদিক থেকে বিদ্যালয়কে ত্রিবিধ দায়িত্ব বহন করতে হয়।
প্রথমত, বিদ্যালয়কে শিশুদের পরিবার সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করতে হয় ও তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রদানের পরিকল্পনা রচনা করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয় শিশুদের মধ্যে গৃহ বা পরিবারের উপযোগিতা সম্পর্কে সংবেদনশীল মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
তৃতীয়ত, বিদ্যালয় গৃহ-পরিবারের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বন্ধনকে আরো দৃঢ়তর করতে সাহায্য করে।
বস্তুত গৃহ বা পরিবারের সাথে বিদ্যালয়ের এই সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সুরটি শিশুশিক্ষার এক অমূল্য পাথেয়। শিশুর যথাযথ শিক্ষার জন্য এবং আগ্রহ, কল্পনা, প্রবণতা, আচরণ প্রভৃতিকে সুনিয়ন্ত্রণের জন্য কেবলমাত্র পিতামাতাকেই শিক্ষিত ও কৃষ্টিসম্পন্ন হলে চলবে না, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পিতামাতার সাথে বিদ্যালয়ের সহযোগিতার সম্পর্কটুকু নিবিড় করতে হবে। বিদ্যালয়কে সর্বদাই মনে রাখতে হবে যে এই বিজ্ঞানসম্মত নসম্মত ও সুস্থ শিশুশিক্ষার সুকঠিন দায়িত্ব পালন তার একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের জীবনে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মূর্ত করে তোলার জন্য বিদ্যালয়কে গৃহ বা পরিবারের সাথে সুসম্পর্কের ভাব গড়ে তুলতেই হবে। বস্তুত শিশুদের সুষম ও সর্বাঙ্গীণ জীবন বিকাশের ধারাকে সরল ও স্বাভাবিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিদ্যালয়কে সমাজ ও পরিবারের সকল কাম্য ও বাঞ্ছিত আয়োজনকে স্বাগত জানাতে হবে।
প্রথমত, সুস্থ শিক্ষার স্বার্থে বিদ্যালয় নিজেকে একটি সরলীকৃত, পবিত্রীকৃত, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে গড়ে তুলে সমাজের জটিল অবিন্যস্ত, বিশৃঙ্খল, অসংগতিশীল ও পঙ্কিল আবহাওয়া থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা নেবে।
দ্বিতীয়ত, গৃহের প্রয়োজনীয় পরিবেশ বিদ্যালয়ে মূর্ত করে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ সুষম ও স্বাভাবিক বিকাশের পথকে সহজ ও সরল করে তুলবে। শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক ও সর্বোত্তম জীবন বিকাশের স্বার্থে বিদ্যালয় যেমন সমাজের সাথে সংযোগ রাখার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করবে, তেমনি গৃহের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য কয়েকটি বিজ্ঞানসম্মত পন্থাও অবলম্বন করার ব্যবস্থা নেবে।
যে সকল পন্থা অবলম্বন করে পরিবারের সাথে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা যায় তাদের মধ্যে শিক্ষক-অভিভাবক সংস্থা স্থাপন, বিদ্যালয়ে অভিভাবক-দিবস পালন, শিক্ষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার্থীদের গৃহ-পরিবেশ পরিদর্শন, অভিভাবক বা পিতামাতার কাছে শিক্ষার্থী সম্পর্কে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গৃহের বা পরিবারের সঙ্গে একমাত্র সম্পর্কের ভিত্তিতেই বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার দ্বারা কাম্য ও বাঞ্ছিত সামাজিক আচরণধারাকে মূর্ত করতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনার পটভূমিকায় শুধু গৃহ-পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষা সুষমভাবে ও সর্বাঙ্গসুন্দর পথে কখনই বিকাশলাভ করতে পারে না। প্রয়োজন সুস্থ সামাজিকীকরণের, আর এজন্য প্রয়োজন গৃহের প্রভাবের সাথে বিদ্যালয়ের প্রভাবের সংযোগ সাধন। আবার শুধু গৃহ-বিদ্যালয় সম্পর্ক নয়, বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যেও প্রয়োজন সুনিবিড় সম্পর্ক।
পরিশেষে বলা হয় যে গৃহে শিশুর প্রাথমিক জীবনের যে অভ্যাস, রুচিবোধ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় তার বিপরীত প্রতিফলন বিদ্যালয়ে থাকলে এবং বিদ্যালয়-পরিবেশ সমাজ-পরিবেশের বিপরীতধর্মী হলে বিদ্যালয়ের পক্ষে সুশিক্ষা প্রসারে কাম্য ও বাঞ্ছিত অবদান রাখা কোনমতেই সম্ভব নয়। তাই আধুনিক শিক্ষাবিদরা বলেন গৃহ-পরিবেশ, বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে সুস্থ, সরল, সুন্দর ও স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেই সম্ভব শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ ও সর্বোত্তম বিকাশ।