“বিদ্যার সাগর তুমি, বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেইজনে জানে,
দীন যে দীনের বন্ধু!”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এই কথাগুলি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত একটি সনেটের মধ্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar) প্রতি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কতখানি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা সচেতন পাঠকদের কাছে অজানা নয়। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরের কাছে ছিলেন আক্ষরিক অর্থে নানাভাবে ঋণী। এই ঋণ গ্রহণের আগে ও পরে বিদ্যাসাগর-চরিত্র বিষয়ে কবি ছিলেন বিশেষভাবে সচেতন। পত্নী হেনরিয়েটাকে এই মানুষটির সম্পর্কে পরিচয় দিতে গিয়ে মধুসুদন বলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কর্মক্ষমতা হল একজন ইংরেজের মতন, তাঁর পান্ডিত্য ভারতীয় ঋষিদের তুল্য এবং এই বিরাট মানুষের হৃদয়টি হল ঠিক ‘বাঙালি মায়ের মতো কোমল’।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হুগলি জেলার (বর্তমানে মেদিনীপুর) বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। তাঁর জন্ম নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র। বাবার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখাপড়ার প্রাথমিক পর্ব গ্রামের পাঠশালায় অতিবাহিত হয়। একান্ত শৈশবে পায়ে হেঁটে তিনি কলকাতায় আসেন। পড়াশোনা আরম্ভ করেন সংস্কৃত কলেজে। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন । তিনি মেধার স্বীকৃতি হিসাবে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পান। হিন্দু ল’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রথমে সংস্কৃত কলেজের সহ-সম্পাদক এবং আরও কিছু পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।
বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মধ্যে একাধারে ছিল আধুনিকতা এবং অপরিসীম প্রাণশক্তি। তিনি প্রথাগত শিক্ষার বদলে চেয়েছিলেন যথার্থ শিক্ষা চালু করতে। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যেসব সংস্কার করেন, সেগুলি বিদ্যাসাগরের আধুনিক মনের পরিচয়বাহী। বিরতি দিবসের পরিবর্তন, মাহিনা প্রবর্তন, পাঠক্রম সংস্কার, সংস্কৃতের জটিল ব্যাকরণের পরিবর্তে সহজবোধ্য নতুন ব্যাকরণের সৃষ্টি, গণিতে ইংরেজির ব্যবহার, দর্শনে পাশ্চাত্য লজিকের প্রবর্তন, এসব তাঁরই কীর্তি। এছাড়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ তিনি করেন, তা হল সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণেতর জাতির প্রবেশাধিকার দেওয়া। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা-সংস্কার কেবল এখানে আটকে ছিল না। স্কুল-বিভাগের সর্বস্তরের জন্য নতুন করে তিনি পাঠ্যবই লিখতে আরম্ভ করেন। লিখলেন, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘ঋজুপাঠ’ ইত্যাদি গ্রন্থ। এই সঙ্গে বাংলা গদ্যের তিনি নতুন রূপ দিলেন। লিখলেন, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ এবং ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর মতো বই।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিচয় ও প্রতিভা এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি কেবল শিক্ষা সংস্কারক নন, বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী নন, তিনি বিশিষ্ট ছিলেন তাঁর অসাধারণ মানবপ্রীতিতে এবং চারিত্রিক দৃঢ়তায়। যে-কথা মাইকেল বলেছিলেন হেনরিয়েটাকে, সেই কথাটি বিদ্যাসাগরের যথার্থ পরিচয়। রাজা রামমোহন যেমন ‘সতীদাহ প্রথা’ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর তেমনি চেয়েছিলেন বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও কৌলীন্য প্রথা বন্ধ করে দিতে এবং ‘বিধবা-বিবাহ’ চালু করতে। মেয়েদের ওপর সেকালে ভয়ংকর যেসব মানসিক নিপীড়ন ছিল, তা সর্বৈব বন্ধ করে, তিনি মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। নিজের আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, আদর্শচ্যুতি তিনি একদম সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর চরিত্র ছিল বজ্রের মতো কঠোর, আবার হৃদয় ছিল কুসুমের মতো কোমল। তিনি মুখে যা বলতেন, তা নিজের জীবনে পালন করতেন। বিধবা-বিবাহের প্রবর্তনায় বৃত হয়ে তিনি নিজের ছেলের বিবাহ দিয়েছিলেন একটি বিধবা কন্যার সঙ্গে। মা-বাবার প্রতি বিদ্যাসাগরের শ্রদ্ধা ছিল অসাধারণ। সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তাঁর প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তেমন খরচপাতি ছিল না। অথচ পরের দুঃখে তিনি অনায়াসে অজস্র টাকা খরচ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ তাঁর অজেয় পৌরুষের জন্য তিনি ছিলেন একান্ত নির্ভীক, বড়ো বড়ো রাজা-মহারাজা থেকে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কারসাহেব পর্যন্ত সকলে তাঁর তালতলার চটির কাছে ছিল অবনত। আর তাঁর মনুষ্যত্ব তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সকল রকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা ও নিষ্ফল আড়ম্বর তাঁর মনুষ্যত্বকে কখনও খর্ব করতে পারেনি। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি বাঙালি হয়েও ‘মানুষ’ ছিলেন। এ ধরনের মনুষ্যত্ব এ পর্যন্ত আমাদের সমাজে ও দেশে বিকশিত হতে দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগর ছিলেন নিজেই নিজের এক বিরল উদাহরণ এবং ইতিহাসের অনন্য মহামানব।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিদ্যাসাগর বন্দনায় যে-কথা ধ্বনিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা তার থেকে আর একটি পৃথক ছবি ফুটে ওঠে। এ ছবি তাঁর সারস্বত-প্রতিষ্ঠার ছবি।—এখন রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি দিয়ে বর্তমান আলোচনার উপসংহার টানা যেতে পারে:
‘বঙ্গসাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে
অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত।
কী পুণ্য নিমেষে
তবে শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা
প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,
বঙ্গভারতীয় ভালে পরাল প্রথম জয়টীকা।
রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিল নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্বদিগন্তের বনে-উপবনে
নব উদ্বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে।’