বৈশাখের বিকেলে গুমোটের বর্ম ভেদ করে হা-হা করে ছুটে এসে তাণ্ডবনৃত্যে যে ঝড় হঠাৎ সব কিছু এলোমেলো করে দিতে পারে, সেই ঝড়ের নাম হল, ‘কালবৈশাখী’ (Kalbaisakhi)। বৈশাখ মাসে কালবৈশাখী ঝড়ের দাপট বেশি, তাই এই রুদ্র-ভয়ংকর ঝড়টি ‘বৈশাখী’ আখ্যা পেয়েছে। নতুবা এটিকে কালভৈরবের চেলা বলে অন্য কোনো নামে ডাকা যেত। তবে এই পাগলা ঝড় মাসের সময়-সীমাকে বড়ো একটা সমীহ করে না। চৈত্র থেকেই সে আমাদের ওপর হানা দিতে আরম্ভ করে, এবং জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত অনায়াসে ও অবাধে সে লুঠতরাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
কালবৈশাখী ঝড় কী সর্বনাশা মূর্তি নিয়ে দেখা দেয়, তা নিজের চোখে না দেখলে কাউকে বোঝানো কঠিন। কখনো মনে হয় কালবৈশাখী ঝড়টির চরিত্রের সঙ্গে বাজপাখির সাদৃশ্য আছে। আবার পরক্ষণে মনে হয় বাজপাখি নয়, এর সাদৃশ্য আছে—ডাকাতদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় দুটি উপমাই ব্যবহার করেছেন এই ঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে। বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে দেখেছিলেন কবি শ্যেনপাখির মতো এই ঝড়কে। আবার শেকল-ছেঁড়া কয়েদি ডাকাতের মতো এই ঝড়ের দস্যুতার কথাও তিনি কবিতায় লিখতে ভোলেননি।
কালবৈশাখী ঝড়ের উৎস কী, তা নিয়ে আবহাওয়াবিদরা সম্ভবত একমত নন। কিন্তু এই ঝড়ের তাণ্ডব যে কী ব্যাপক, কী ভয়ংকর ও সর্বনাশা, তার অভিজ্ঞতা সম্ভবত অনেক বড়ো বড়ো জ্ঞানী ব্যক্তিদের গোচরে নেই। আমাদের বাংলাদেশে এই ঝড়ের তাণ্ডবে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক বড়ো বড়ো গাছ ভুলুণ্ঠিত হয়। শাখাপ্রশাখা ভেঙে পড়ে। ইলেকট্রিকের তার, টেলিফোনের লাইন ছিঁড়ে যায়। খড়ের চালাঘর উড়ে যায়, টালির ছাউনি ভেঙে পড়ে। বৈশাখ মাসে গাছভর্তি আম থাকে। সেই আম ছড়িয়ে পড়ে গাছের তলায়। নদীপথে নৌকা ও জাহাজের ওপর এই ঝড়ের হামলা কম হয় না। নদীপথে নৌকাডুবির ফলে প্রতি বছর বহু লোক অকস্মাৎ প্রাণ হারায় এবং বিনষ্ট হয় দেশের বহু সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে এই ঝড়ের বর্ণনা এবং তৎসহ নৌকাডুবির করুণ নির্মম ছবি দেখতে পাওয়া যায়—টাইফুন ও হারিকেন ঝড়ের মতোই এ ঝড় সর্বনাশা।
আমরা যারা শহরে বাস করি, তারা অবশ্য এই ডাকাত-ঝড়ের হাত থেকে কিছুটা নিরাপদে থাকি। তবে সর্বৈব নিরাপদ, একথা বলা যায় না। এই ঝড় উঠলে ‘প্রাসাদ নগরী’ কলকাতার শহরের চিত্র প্রাসাদগুলি অবরোধ সৃষ্টি করে এর প্রকোপ খানিকটা কমিয়ে দেয়। তবে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে বিজ্ঞাপনের বড়ো বড়ো কাঠের তক্তাগুলো ঝড় ভেঙে দেয়, করোগেটেড টিনের ছাদ ও ছাউনির মাথা উড়িয়ে দেয় এবং ময়দানে গিয়ে গাছ ফেলে দেয়। এই শহর একদা যখন এইভাবে ইটের খাঁচায় পরিণত হয়নি, তখন কিন্তু এই ঝটিকা প্রকৃত ঝটিকার মতোই শহরবাসীদের দরজা জানালা ঝাঁকিয়ে বেড়াত। ঘরে ঘরে ত্রাস সঞ্চার করত।—পুরনো দিনের সংবাদপত্রে এইসব ত্রাসের অনেক খবর পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বহু সর্বনাশা সমাচার।
মৌসুমি বৃষ্টির স্নিগ্ধতা যে কালবৈশাখীর নেই, তা আমরা জানি। কিন্তু তাই বলে এই ঝড়ের দ্বারা আমরা একেবারেই উপকৃত হই না, এমন মনে করলে ভুল হবে। আমরা ঝাড়ুদার রাখি। প্রকৃতির এইরকম ঝাড়ুদার হল কালবৈশাখী। জীর্ণ পুরাতন বৎসরের সব আবর্জনাকে বিদায় জীর্ণতার প্রতিকারক করে দিয়ে নতুনকে অভিষেক করাই হল কালবৈশাখীর কাজ। আসলে সে নতুনের দূত। নতুন বছরের আগমনবার্তা সে নিয়ে আসে। তাই তাকে ডাকাত বা বাজপাখি বলে আমরা তার আংশিক ও একপাশের ছবি আঁকি। গোটা ছবিটা দেখলে তার আপাত রুক্ষতার ভেতর সৃষ্টিশীল একটি উদ্যোগ আবিষ্কার করা কিছু কঠিন নয়।
কালবৈশাখী যেহেতু নতুনের দূত, তাই সে রুদ্রেরও অনুচর। নটরাজ রুদ্র সংহারের জন্য একটি পায়ে পিষ্ট করেন ভূমিতল, তাঁর উত্থিত অন্য পায়ে দেন সৃষ্টির আশ্বাস। ‘কালবৈশাখী’ রুদ্রের অনুচর হিসাবে একই সঙ্গে করে থাকেন সংহার ও সৃষ্টি। ভয়ংকরের ব্যাখ্যা সঙ্গে সুন্দরের ও সুন্দরের সঙ্গে কল্যাণের যোগেই কালবৈশাখীর প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত। এখানেই তার যথার্থ স্বরূপ প্রকাশিত।