শীতের সকাল (Winter Morning) বললেই অনেকের মনে একটি শীতল বিষণ্ণ ছবি ফুটে ওঠে। বাতাসে শুষ্কতা, জলে ঠান্ডার কনকনানি এবং সর্বোপরি সারা গায়ে সর্বদা একগাদা কাপড় চাপিয়ে রাখা, এর নামই যেন শীতকাল। অনেকেই পছন্দ করেন না এই ধরনের এক অস্বস্তিকর জীবনযাত্রা। তাঁদের কাছে শীতকালটি হল সংকুচিত এক জীবনধারণের বোঝা স্বরূপ। খোলামেলা হয়ে না-থাকার বাধা তাদের মনকে করে পীড়িত। সুতরাং এইসব মানুষের কাছে শীতের সকাল আদৌ পছন্দ নয়। বরং শীতটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই তাঁরা আগ্রহী।
আমার কাছে কিন্তু শীতের সকাল ভারী মনোরম। আমরা যেখানে থাকি, তার সামনে রয়েছে অনেকখানি খোলা মাঠ। মাঠের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ছোট্ট জলভরা একটি খাল। মাঠের একদিকে সোনার ফসল, অন্যদিকে সবুজের মেলা। কপি-মটরশুঁটি-সিম-পালং শীতের শস্যক্ষেত্রে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন। খেজুরের রস আর নলেন গুড়ের সময় হল শীতকাল। গম, আখ এবং আলুর চাষ এই সময় হয়। মাঠের দিকে তাকালেই মনে হয় মা-অন্নপূর্ণা যেন জাঁকিয়ে বসে আছেন তাঁর শস্যভাণ্ডার নিয়ে।
একরাশ রোদ্দুর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের বারান্দায়। গোটা বারান্দাটা মিঠা অথচ উষ্ণ রোদে ভরে যায়। আমাদের বাংলোর সামনের ফুলের বাগানটি ভরে ওঠে রোদ্দুরে। প্রাঙ্গণের শিশির স্নিগ্ধ ঘাসে ঝলমল করে প্রভাতী সূর্যালোক। নানা রঙের গোলাপ, ডালিয়া, ক্রিসান্থিমাম এবং মরশুমি ফুলগুলি বন্দনা করে স্নিগ্ধ রবিকরকে।—আগে এই সময় বাগান-চেয়ারে বসে আমরা সকালের চা-টা খেতাম। আজও খাই। ধূমায়মান চা। চা খাওয়ার মুহূর্তে টেবিলে এসে যায় প্রভাতী কাগজ। এই কাগজ পড়তে পড়তে চা-পানের আশ্চর্য একটি উত্তেজনা আছে। শীতের এই সময়টায় আমাদের মন থাকে ভারমুক্ত। ইস্কুলের অর্ধ-বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে যায়। পরীক্ষার ফল ঘোষিত হয়ে যায়। এদিকে নতুনভাবে পড়াশোনা তেমন করে আরম্ভ হয় না। সুতরাং এই সময়ের মতো ভারহীন ও চিন্তাহীন মন-মেজাজ সারা বছরে আমাদের কখনো থাকে না।
শীতের সকালে আমরা সবথেকে বেশি করে উপভোগ করে থাকি বড়োদিনের অবকাশ। উপভোগ করি বড়োদিনের আনন্দ উৎসব। আগে বড়োদিনে পাওয়া যেত নানা ধরনের কেক। এখনও সেসব আসে, তবে আগের তুলনায় কম। আমাদের পৌষপার্বণও পড়ে এই সময়। নলেন গুড়ের সঙ্গে পিঠের স্বাদ ভারী মনোরম। কমলালেবু, আপেল, নাশপাতি, আঙুর এবং সবুজ মটরশুঁটির ঋতু হল এই শীতকাল। আগে আমাদের প্রাতরাশে এদের অনেকের দেখা পেতাম এবং আজও কাউকে কাউকে পাই। ভেটকি মাছের স্বাদ এই সময় আশ্চর্য রকমের ভালো। সঙ্গে ‘লবস্টার’ যদি জোটে, তবে তো কথাই নেই!
তবে শীতের সকাল সব থেকে আনন্দময় হয়ে ওঠে চড়ুইভাতি আর ক্রিকেট খেলায়। আগেই বলেছি, আমাদের বাংলোর সামনে রয়েছে বিশাল এক চাষের মাঠ। এই মাঠেরই রাস্তার ধারে রয়েছে আমাদর স্কুলের খেলার মাঠ। সংখ্যায় আমরা অনেক। অনায়াসে দুটি টিম গড়ে ওঠে ক্রিকেট খেলার জন্য। নিজেদের ভেতর তখন কেউ হই বিরাট কোহলি, আবার কেউ-বা বাবর আজম। দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ খেলার মধ্য দিয়ে শীতের সকাল গড়িয়ে যায় দুপুরে। মটরশুঁটি আর ছোলাখেতের ভেতর দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসি দুপুরের লাঞ্চ সারতে।
চড়ুইভাতি হয় মাঝে মাঝে। আমাদের বাংলোর বারান্দায় বসলে দক্ষিণ দিকে অনেকদূরে দেখা যায় একটি পাথুরে পাহাড়। সেই পাহাড়ের কোল দিয়ে একটি বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে স্টেশনের দিকে। আমাদের বাংলো থেকে এ জায়গাটির দূরত্ব হল প্রায় তিন মাইল। আমরা দল বেঁধে সাইকেলে করে ওই পাহাড়ের ওপর প্রতি বছর যাই চড়ুইভাতি করতে। ভোর হতে-না হতে আরম্ভ হয় ছোটাছুটি। এই চড়ুইভাতিতে আমরা নিজেরাই রান্না করি। একবার রান্না শেষে খাওয়ার সময় একটি মজার জিনিস অনুভব করেছিলাম। কপির তরকারি এবং মাংসের ঝোলে আমরা বেমালুম নুন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই আলুনি খাবার খেয়ে আমরা গান গাইতে গাইতে ফিরে এসেছিলাম সুদীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে।
শীতের সকাল প্রতি বছরের মতন এবারও এসেছিল। এসেছিল আমাদের কাছে একটি কবিতার মতনই সুন্দর হয়ে। ধানের শিষে শিশিরবিন্দুর মতনই শীতের সকাল আজও আমাদের টানে। আজও শীতের সকাল আমাদের কাছে মধুমাখা।