আবদুল হামিদ লাহোরী মুঘল যুগের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ছিলেন। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ইতিহাস চর্চা করেন। আব্দুল হামিদ লাহোরীর ঐতিহাসিক রচনা ‘পাদশাহনামা’ হল শাহজাহানের রাজত্বকালের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস। আব্দুল হামিদ লাহোরী ইতিহাস রচনায় মহম্মদ আমিন কাজভিনির রচনার ওপর নির্ভর করেছিলেন। লাহোরীর ‘পাদশাহনামা’ রচনার পূর্বে মহম্মদ আমিন কাজভিনি শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথম দশ বছর (১৬২৭-৩৬ খ্রিঃ) সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘পাদশাহনামা’।
আব্দুল হামিদ লাহোরী ইতিহাস রচনায় কাজভিনির রচনার ওপর নির্ভর করেছিলেন। শাহজাহান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে কাজভিনিকে সরকারি মহাফেজখানার মুন্সী পদে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনায় আকৃষ্ট হয়ে শাহজাহান ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দরবারী ঐতিহাসিক করেন। কাজভিনি শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম দশ বছরের ইতিহাস রচনা করেন ‘পাদশাহনামা’ নামক গ্রন্থে। কিন্তু কাজভিনিকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে বয়স্ক বিদ্বান আবদুল হামিদ লাহোরীকে দরবারী ঐতিহাসিক পদে নিয়োগ করেন। আবদুল হামিদ লাহোরি আবুল ফজলের সমপর্যায়ের লেখক ছিলেন।
আব্দুল হামিদ লাহোরী ছিলেন আবুল ফজলের মতো খ্যাতনামা ঐতিহাসিক। লাহোরী শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথম কুড়ি বছরের (১৬২৭–১৬৪৭ খ্রিঃ) ইতিহাস রচনা করেন। শাহজাহানের রাজত্বকালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান হল ‘পাদশাহনামা’। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শাহজাহানের রাজত্বকালের সব খুটিনাটি বিষয় লিখেছেন। শাহজাদা খুররমের জীবন কাহিনি ও সম্রাট শাহজাহানের কীর্তি-কাহিনি তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। আকবরের রাজত্বকাল সম্পর্কে আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য, তেমনি শাহজাহানের রাজত্বকালের ইতিহাস জানার জন্য লাহোরির পাদশাহনামা’ গ্রন্থটি সমান গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা আব্দুল হামিদ লাহোরীর ‘পাদশাহনামা’ গ্রন্থটির সাহায্য নিয়ে এবং লাহোরীর রচনাকে অনুসরণ করে শাহজাহানের রাজত্বকালের ইতিহাস রচনা করেছেন। লাহোরী অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহজাহানের শেষ দশ বছরের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব লাহোরির ছাত্র ও অনুরাগী মহম্মদ ওয়ারিসকে দেওয়া হয়েছিল। ওয়ারিসের লেখা ‘পাদশাহনামা’ শাহজাহানের ৩০ বছর রাজত্বকালের ইতিহাস। ওয়ারিস শাহজাহানের প্রথম ২০ বছরের ইতিহাস তাঁর গুরু লাহোরিকে অনুসরণ করে লেখেন এবং শেষ দশ বছরের শাসনকালের ইতিহাস তিনি নিজে স্বাধীনভাবে লেখেন।
লাহোরী প্রথম দশ বছরের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মূলত কাজভিনির রচনাকে অনুসরণ করেন। তবে তিনি বিষয়বস্তু উপস্থাপনা ও তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ধারা ও নতুনত্বের সংযোজন করেছেন। আব্দুল হামিদ লাহোরী শাহজাদা খুরমের জীবন কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। যুবরাজ খুররম পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তার বিস্তৃত বিবরণ তিনি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন এজন্য নূরজাহানের চক্রান্ত দায়ী ছিল।
তিনি শাহজাহানের সব নথিপত্র দেখেছিলেন, দরবারের সব গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলি থেকে তথ্য আহরণ করেছিলেন এবং ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি যত্ন সহকারে সমস্ত সামরিক অভিযানের উল্লেখ করেছেন। যে সব সামরিক অভিযানগুলির চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটেছিল সেগুলিরও নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন। সম্রাট শাহজাহান কাদের পেনসন মঞ্জুর করেছেন, মনসব দিয়েছেন, নতুন পদে নিয়োগ করেছেন, জন্মদিন ও সিংহাসন আরোহনের দিনে উৎসব হয়েছে সব কিছুরই বর্ণনা পাওয়া যায় আবদুল হামিদ লাহোরীর পাদশাহনামা নামক গ্রন্থে।
পাদশাহনামা দরবারের ঐতিহাসিক দ্বারা রচিত ইতিহাস গ্রন্থ। আবুল ফজল বা আবদুল হামিদ লাহোরী স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষ ইতিহাস লিখেছেন একথা বলা চলে না। সম্রাট ও মন্ত্রীদের নির্ভীকভাবে সমালোচনা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবুল ফজল ও আবদুল হামিদ লাহোরী যে ধরনের দরবারী ইতিহাস লিখেছেন তার বহু ত্রুটি ছিল। দরবারী ইতিহাসে আছে সম্রাট সম্পর্কে অতিরঞ্জন ও চাটুকারিতা এবং অলংকার-বহুল গুরুগম্ভীর ভাষা।