রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় দর্শন, ইতিহাস, আইনের প্রাধান্য স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গিকে ঐতিহ্যগত বা সনাতন বা পরম্পরাগত বা রীতিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি (Traditional Approaches) বলে বর্ণনা করা হয়। ‘ঐতিহ্যগত’ আখ্যা প্রদানের মাধ্যমে কোন সমালোচনা বোঝায় না। পরম্পরাগত মতামত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এখন মূল্যবান বলে পরিগণিত হলেও তাদের একচেটিয়া অধিকার বা প্রভাব বর্তমানে নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি [Traditional Approaches of Political Science]
(১) দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্রাচীনত্বের দাবিতে দার্শনিক, পদ্ধতির স্থান সর্বোত্তম। দার্শনিকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও মানুষের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে একটি আদর্শ রূপ নির্ধারণ করা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, সমাজে ব্যক্তির স্থান, নাগরিকের অধিকার কর্তব্য, আইন প্রভৃতি মৌল নীতি স্থির করা। দার্শনিকরা অবরোহ পদ্ধতির (Deductive) মাধ্যমে পূর্বকল্পিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করে ছিল। তাঁদের বাস্তব রাজনৈতিক জগৎ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের লক্ষ্য ছিল না। আদর্শবাদী বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য সমর্থক ছিলেন প্লেটো, কান্ট, হেগেল, গ্রীন, ব্রাডলে, বোসাংক। অ্যারিস্টটল ‘Politics’ গ্রন্থের আলোচনায় বিভিন্ন নগর- রাষ্ট্রের সংবিধানকে উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেন; ম্যাকিয়াভেলির ‘Prince’ গ্রন্থটি নবজাগরণের যুগে ইতালীর বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার বাস্তব রূপের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রচিত হয়। মাও-সে-তুং-এর রাজনৈতিক দর্শনকে অগ্রাহ্য করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
(২) ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি: অ্যালান বল ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে অন্যতম ঐতিহ্যগত বা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি বলে উল্লেখ করেছেন। অতীতের সংগৃহীত উপাদান বিশ্লেষণ করে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে পরীক্ষা সাপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ হল ঐতিহাসিক বর্ণনামূলক পদ্ধতি। রাষ্ট্রনায়কদের স্মৃতিকথা, জীবনী থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের বর্ণনা পর্যন্ত তথ্য হিসাবে গৃহীত হয়। ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন সংগৃহীত উপাদান বিচারবুদ্ধির সাহায্যে বিশ্লেষণ করে মৌলিক বিষয়ে সুসংগত রূপ দান করেন। ঐতিহাসিক পদ্ধতি মূলতঃ বর্ণনামূলক, কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পদ্ধতির মূল্য স্বীকার করলেও সংগৃহীত উপাদানের নির্ভরযোগ্যতা পরিবর্তিত সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের পটভূমিকায় যাচাই করা প্রয়োজন। ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করলে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।
(৩) আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি: আইনগত পদ্ধতিকে অনেকে অন্যতম ঐতিহ্যগত বা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি বলে অভিহিত করে। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপের অন্যান্য অংশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আইনগত পদ্ধতির অনুসরণ অপরিহার্য বলে গণ্য হত। ব্রিটেনে ডাইসীর ‘Law of the Constitution’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আইনগত প্রভাব বিশেষ বৃদ্ধি পায়। আইনগত পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হল শাসন ব্যবস্থার আইনগত ভিত্তি, রাষ্ট্র ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনগত প্রকৃতি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা। কিন্তু আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন সমাজ বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। বর্তমানে আইনগত পদ্ধতির প্রাধান্য হ্রাস পেলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এর প্রভাব সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না।
ঐতিহ্যগত বা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির অসম্পূর্ণতার জন্য সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় দর্শন, ইতিহাস বা আইনের প্রভাব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা যায় না। বর্ণনামূলক এবং প্রতিষ্ঠানগত পদ্ধতির মধ্যে এই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতির নতুন নতুন দিক উদ্ভাবন সত্ত্বেও বর্তমানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যথা — শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতির সংগঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আইনগত পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়, বিভিন্ন সংস্কারের সুপারিশ করা হয়।
(৪) তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি: তুলনামূলক পদ্ধতিকে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির যোগসূত্র বলা যেতে পারে। তুলনামূলক পদ্ধতি অত্যন্ত প্রাচীন। অ্যারিস্টটল বা হেরোডোটাসের রচনাতে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান পাওয়া যায়। তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে অতীত বা বর্তমানের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে আধুনিককালে বোঁদা, মন্তেষ্কু, ব্রাইস অনেকে তুলনামূলক পদ্ধতির অনুসরণ করেন। তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবন্ধতা সম্পর্কে সচেতন হবার প্রয়োজন আছে। প্রথমত, সংগৃহীত তুলনীয় তথ্যগুলিকে নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তিতে বিন্যাস করবার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তুলনার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সমতা রয়েছে কিনা তার বিচার প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কোন বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা কার্যাবলী কোন একটি রাষ্ট্রে কেন লক্ষ্য করা যায় তার উত্তর তুলনামূলক পদ্ধতিতে মেলে না। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা [Limitations]
ঐতিহ্যগত বা সনাতন বা পরম্পরাগত বা রীতিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা নিচে আলোচনা করা হল—
(১) ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক বিষয় যেমন জনমত, রাজনৈতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, ভোট সম্পর্কিত আচরণ ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আসে না। তাই একে অসম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বলা যায়।
(২) ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিতে মানব সমাজের অভ্যন্তরস্থ আর্থ-সামাজিক কারণগুলির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা যায় না। রাজনৈতিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠানিক ও বর্ণনামূলক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সুতরাং রীতিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না।
(৩) পরম্পরাগত দৃষ্টিভঙ্গি আন্তঃসমাজ বিজ্ঞানমূলক আলোচনায় গুরুত্ব আরোপ করে না। কোন সমাজবিজ্ঞান স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, একে অপরের পরিপূরক এবং ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতির আলোচনায় ইতিহাস, অর্থনীতি, নীতিশাস্ত্র, আইন কোন কিছুকে বাড়িয়ে বলা যায় না।
(৪) সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আলোচনার মধ্যে মূলত সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সংকীর্ণ হতে বাধ্য।
(৫) ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত আচার-আচরণের বিচার বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়না। প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার মধ্যে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ থাকে।