আধুনিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবর্তিত উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy) পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলেও অভিহিত হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে আধুনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্রে মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব এবং বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের তত্ত্ব বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছে। মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের শাসন বা তত্ত্বের সমর্থকগণের মধ্যে পেরেটো (Pareto), মস্কা (Mosca), মিচেল (Mitchell) প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। তাঁদের মতে, সমাজে মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠ বা বাছাই মানুষই প্রধান সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা তা মেনে চলে। বহুত্ববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাগণ বলেন, সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেন্টলী (Bentley), ট্রুম্যান (Truman), ডাল (Dahl) প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মুষ্টিমেয় বাছাই করা তত্ত্বের বিরুদ্ধে গোষ্ঠী তত্ত্বের কথা প্রচার করেন।
আধুনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য (Features of Liberal Democracy)
(১) রাজনৈতিক সাম্য: উদারনৈতিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক সাম্যের ওপর গণতান্ত্রিক গুরুত্ব আরোপ করে। গণতন্ত্র হল “জনগণের কল্যাণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত, জনগণের সমর্থন।” সার্বিক বয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিটি ব্যক্তির একটি ভোটের অধিকার স্বীকার করে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। বাস্তবক্ষেত্রে গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও গণতন্ত্র সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করে এবং সকলের মতামতকে শ্রদ্ধা করে।
(২) রাজনৈতিক ও পৌর অধিকার গুরুত্ব লাভ করে: উদারনৈতিক গণতন্ত্র ব্যক্তি-মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করে। প্রত্যেক ব্যক্তি অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সার্থক হয়ে উঠবে বলে এই দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থকগণ আশা প্রকাশ করেন। ব্যক্তির পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারগুলি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। জীবনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, ধর্মের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার, ভোটদানের অধিকার, নির্বাচিত হবার অধিকার, সরকারের সমালোচনার অধিকার প্রভৃতি নাগরিক জীবনের বিকাশে এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় একান্ত প্রয়োজনীয় বলে গণ্য হয়।
(৩) নির্বাচন ব্যবস্থা: উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল নির্বাচন ব্যবস্থা-অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিগণ সত্যকার জনগণের সরকার গঠন করতে পারে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি বা দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে সরকারকে পরিবর্তনের জন্য কোন নিয়ম বহির্ভূত বৈপ্লবিক পন্থা অনুসরণ করতে হয় না। ‘ব্যালট বাক্স’-এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন সম্ভব হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্র বিপ্লব ও হিংসাকে সমার্থক মনে করে এটি পরিহার করতে হয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের কর্তৃত্ব এবং জনকল্যাণের অনুপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
(৪) সার্বিক বয়স্কের ভোটাধিকার: অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার পাশাপাশি সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ব্যবস্থাকে জনগণের সার্বভৌমত্বকে রূপায়িত করবার প্রধান মাধ্যম বলে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্রকে জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা হিসাবে স্বীকার করতে হলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে অপরিহার্য অঙ্গ বলে মানতে হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকার ছাড়া অন্য কোন উপায়ে জনগণের শাসন সফল হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
(৫) একাধিক রাজনৈতিক দল: উদারনৈতিক গণতন্ত্র একদলীয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল নয়, একাধিক দল প্রথায় প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিফলিত হতে পারে। একাধিক দলের মাধ্যমে সমাজ জীবনের বিচিত্র ও জটিল সমস্যা সার্থকভাবে প্রকাশিত হতে পারে এবং তাদের সমাধানের উপযুক্ত পথ জনগণের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়।
(৬) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন (rule of law) এবং ন্যায়বিচারের (justice) ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আইনের অনুশাসন এবং আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হতে পারে। প্রাসঙ্গিকভাবে এর জন্য প্রয়োজন এক স্বাধীন নিরপেক্ষ আদালত। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের স্বৈরাচার হতে জনগণের অধিকার রক্ষায় সমর্থ। সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসাবে এবং মৌলিক অধিকারের রক্ষক হিসাবে নিরপেক্ষ বিচারালয় গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে।
(৭) সম্পত্তির পবিত্র অধিকার: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র অধিকার বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু বর্তমানের বিভিন্ন পাশ্চাত্ত্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্পত্তির অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করবার ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়।
(৮) সংবিধানের প্রাধান্য: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সংবিধানকে মৌলিক আইন বলে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আমরা জনগণ’ (we the people) কথাগুলির ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা প্রণীত এবং জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান গৃহীত হয়েছে, তা প্রতিফলিত হয়। শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগকেও সংবিধানের সীমা মেনে কাজ করতে হয়। এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন বলে গণ্য হয়।
(৯) সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা: গণতন্ত্র বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারে পরিণত না হয়, সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্যই গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন ব্যবস্থা স্বীকার করা হয়।
(১০) স্থায়ী কর্মচারীদের প্রাধান্য: উদারনৈতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বিশেষ কোন দক্ষতা বা প্রশাসনিক যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। এই অবস্থায় স্থায়ী কর্মচারীগণ রাজনৈতিক উত্থান-পতনের বাইরে থেকে প্রশাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ করে। স্থায়ী কর্মচারীগণের বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা শাসন পরিচালনায় প্রাধান্য লাভ করে। সেজন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।