মার্কসীয় চিন্তানায়কগণ গণতন্ত্রের ধারণাকে বলিষ্ঠ সমর্থন জানালেও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ হিসাবেই সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষায় রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল ব্যাপক সংখ্যক জনগণের গণতন্ত্র, মেহনতী মানুষের গণতন্ত্র এবং সংক্ষেপে এটা হল সর্বহারার গণতন্ত্র বা সর্বহারার একনায়কত্ব।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
(১) অর্থনৈতিক শোষণের বিলোপ: গণতন্ত্র হল এমন এক সমাজব্যবস্থা যাতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য বিরাজ করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্র সাম্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ বা শোষণের অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয় না। এটাকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যায় না। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ও শ্রেণীর বিলোপ ঘটিয়ে সকলপ্রকার শোষণের অবসান সম্ভব করে।
(২) সমগ্র জনগণের গণতন্ত্র: সর্বহারার গণতন্ত্র বা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব পুঁজিবাদের অবসানে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন করে। সর্বহারার একনায়কত্বে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমপরিণতিতে সমগ্র জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সাম্যবাদী সমাজ গঠনের পথে অগ্রসর হয় এবং রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পথ প্রশস্ত করে।
(৩) একদলীয় শাসনব্যবস্থা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র একাধিক দল প্রথায় বিশ্বাসী নয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থ ও চেতনার জন্য একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সকলপ্রকার শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীশোষণের অবসানে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, সুতরাং শ্রমিক কৃষকের স্বার্থে প্রতিনিধিস্বরূপ কমিউনিস্ট দল ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ঘটে না।
(৪) সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকার করা হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মতো অর্থনৈতিক বৈষম্য এই ব্যবস্থায় থাকে না বলে ভোটাধিকারও সার্থক হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগের মধ্য দিয়ে গণ-সার্বভৌমত্ব প্রকৃত রূপ লাভ করে।
(৫) সকল শ্রেণীর অধিকার ভোগের সমান সুযোগ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ- নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার স্বীকার করে। কর্মের অধিকার, বিশ্রাম বা অবকাশের অধিকার, বার্ধক্যে পীড়িতাবস্থা বা অসামর্থ্যের ক্ষেত্রে ভরণ-পোষণের অধিকার যেরূপ স্বীকৃত হয়, তেমন শিক্ষার অধিকার, কর্মের অধিকার, আবাসনের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির অধিকার, বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকার, নির্বাচনের ও নির্বাচিত হবার অধিকারও স্বীকৃত। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য হল এই যে, অধিকারগুলি শুধু ঘোষণা করাই হয় না, অধিকারগুলি যাতে নাগরিকগণ ভোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়।
(৬) সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে ব্যক্তির মর্যাদা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ব্যক্তিকে সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে গণ্য করে। সমাজের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্বও নির্দিষ্ট থাকে। সমাজের অগ্রগতির জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে কাজ করতে হয়। “যে কাজ করবে না, সে খেতেও পাবে না”—এটিই হল মূলনীতি। পরশ্রমজীবী শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব এই সমাজে থাকে না। সমাজতন্ত্রের মূলনীতি—”প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং তার কাজ অনুযায়ী ভোগ করবে”—এই সমাজে বাস্তব রূপ লাভ করে।
(৭) সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হয়: বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সহজাত অপসংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সুস্থ, স্বাভাবিক গণ-সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব করে, বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার বলিষ্ঠ ভিত্তি স্থাপন করে বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
(৮) আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্যের পরিবর্তে গণনিয়ন্ত্রণ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে আমলাগণের বিশেষ প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় না। শাসনব্যবস্থা পরিচালনার সকল স্তরে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া কমিউনিস্ট দলের সর্বব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আমলাতান্ত্রিক কুফলগুলি প্রতিরোধে সমর্থ হয়।
(৯) প্রকৃত ধর্ম-নিরপেক্ষতা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠনের সহায়ক। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সকল সমস্যার বিশ্লেষণ, জনগণের মধ্যে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপক সম্প্রসারণ, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কার হতে নাগরিক মনকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
(১০) সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে দুনিয়ার শ্রমিকের ঐক্য ঘোষণার মাধ্যমে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাকে বলিষ্ঠভাবে প্রচার করে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মানুষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পূর্ণ অর্থে গণতন্ত্রের আদর্শ বাস্তব রূপলাভ করতে পারে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার সুমহান আদর্শ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকেই প্রকৃত গণতন্ত্র বলে অভিহিত করা যায়।