রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধীজীর ধারণা
গান্ধীজী কোনো বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্ব বা দর্শন তত্ত্বের সূত্রপাত করেননি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবনের সমস্যা সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাকে ঐতিহাসিক বিচারে মৌলিক বলে গণ্য করা যায় না। বিভিন্ন চিন্তানায়কের আদর্শ ও লক্ষ্যকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিচারে নতুন করে প্রয়োগ করবার ক্ষেত্রে গান্ধীজী বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রচলিত বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ অর্থাৎ আদর্শবাদ (Idealism), সমাজতন্ত্রবাদ (Socialism) বা মার্কসবাদ (Marxism) কোন রাজনৈতিক দর্শনই গান্ধীজীর জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে নি। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে গান্ধীজী টলস্টয়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ডেভিড থরোর (David Thoreau) চিন্তার কিছু প্রভাবও রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধীজীর ধারণার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। গান্ধীজীর একান্ত সচিব ও জীবনীকার প্যারেলালের মতে, গান্ধীজী শিল্প, ধর্ম, নৈতিকতা, অর্থনীতি এবং বিশেষভাবে রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে টলস্টয়ের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রভাবের ফলে গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় নৈরাজ্যবাদী সমর্থনের অনেক সাদৃশ্য মেলে।
নৈরাজ্যবাদী দর্শন ও গান্ধীজীর রাষ্ট্রতত্ত্ব: গান্ধীজীর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তার সঙ্গে পশ্চিমী রাষ্ট্রতত্ত্বের মিল খুঁজতে অনেক লেখক তাঁর চিন্তাধারাকে নৈরাজ্যবাদী দর্শনের (philosophical anarchism) সঙ্গে তুলনা করেছেন। অধ্যাপক বিনয় সরকার গান্ধীজীকে নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব এবং বলপ্রয়োগ ভূমিকার জন্যই রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধীজী বিরূপ ধারণা পোষণ করেছেন। ডেভিড থরোর মত অনুসরণে তিনি বলেছেন যে, শাসনমুক্ত শাসনব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু অনেক লেখক গান্ধীজীকে নৈরাজ্যবাদী বলতে চান না। নৈরাজ্য দর্শনের প্রবণতা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়ে তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিল না।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধীজী: গান্ধীজীর অহিংস নীতির ওপর গভীর আস্থা এবং পশুবলের প্রতি অশ্রদ্ধা রাষ্ট্র সম্পর্কে তার ধারণার মধ্যে সুপরিস্ফুট। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব ও তার অশুভ প্রভাব সম্পর্কে গান্ধীজী বিশেষ অবহিত ছিলেন। তাঁর মতে, “রাষ্ট্র হল কেন্দ্রীভূত ও সুসংবদ্ধ হিংসা বা বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি- মানুষের একটি আত্মা রয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র হল আত্মাবিহীন একটি যন্ত্র যা সহিংস বলপ্রয়োগ ছাড়া বাঁচতে পারে না।” গান্ধীজী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল বা অকল্যাণকেই আহ্বান করে আনে। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে শোষণের অবসান ঘটাতে সমর্থ হলেও ব্যক্তিত্বের বিনাশ সাধন করে। এই ব্যক্তিত্বই সমাজ প্রগতির মূল কারণ। সুতরাং পাশবিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে গান্ধীজী সমর্থন করতে পারেন নি।
গীতা, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব: রাষ্ট্রকে গান্ধীজী উদ্দেশ্য হিসাবে চিহ্নিত না করে জনগণের জীবনের ব্যাপক কল্যাণ সাধনের মাধ্যম বা উপায় হিসাবে স্বীকার করেন। রাষ্ট্রকে পবিত্র প্রতিষ্ঠান মনে করবার কোন কারণ নেই। মানুষের জীবনের অসম্পূর্ণতা বা দুর্বলতার জন্যই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। রাষ্ট্র যেহেতু কল্যাণ সাধনের মাধ্যম, সেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগে ব্যক্তির নৈতিক অধিকার হবে অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইনকানুনকে প্রতিরোধ করা। সমাজসেবামূলক রাষ্ট্র যত কম কর্তৃত্বের অধিকারী হবে, ততই ব্যক্তির নৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।
সাম্যভিত্তিক শ্রেণীহীন সমাজ: গান্ধীজী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং শ্রেণীহীন সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিলেন। অর্থনৈতিক সাম্য বলতে গান্ধীজী চূড়ান্ত সাম্যের কথা বলেন নি। শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রেণীষন্য বা শ্রেণী সংগ্রামের পথ পরিহার করে শ্রেণী-সমঝোতা বা শ্রেণী সহযোগিতার আদর্শকেই অনুসরণ করবার কথা বলেছেন। গান্ধীজীর শোষণহীন সমাজ অহিংস নীতির ওপর ভিত্তিশীল।
রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের অস্বীকৃতি: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধীজীর নিজস্ব ধারণার ফলে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের তত্ত্বে তিনি আস্থাশীল ছিলেন না। কর্তৃত্বের ভিত্তিতে জনগণের সার্বভৌমত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন। অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতো, রাষ্ট্রও জনগণের কাছে সীমাবদ্ধ আনুগত্য দাবি করতে পারে। এতে নৈরাজ্যের আশঙ্কা থাকলেও রাষ্ট্রীয় শক্তির অপপ্রয়োগ রোধে গান্ধীজী এটি সমর্থন করেন।
গান্ধীজীর আদর্শ—রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র: সুতরাং গান্ধীজীর আদর্শ সমাজব্যবস্থা হল অহিংস নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র। এই গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকেই শাসক। প্রত্যেকে এরূপভাবে নিজেকে পরিচালিত করে যাতে অন্যের পক্ষে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়। এরূপ আদর্শ ব্যবস্থায় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রশ্ন থাকবে না। সত্য ও অহিংসার ভিত্তিতে গঠিত সত্যাগ্রহী গ্রামসমূহের সমবায় হল গান্ধীজীর রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের বাস্তব রূপ। এই সংগঠনের ভিত্তি হবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক। সমাজজীবনে সাম্য বিরাজ করবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের জন্য কাজ করবে, প্রত্যেকে রুটির জন্য শ্রম করবে, এটিই হল রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের আদর্শ। এরূপ সমাজে শোষণের কোন সুযোগ থাকবে না। রাষ্ট্রবিহীন অহিংস গণতন্ত্রই হল গান্ধীজীর স্বপ্নের ‘রামরাজ্য’। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, এই আদর্শ রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করবে, সে সম্ভাবনায় গান্ধীজী নিজেই স্থির বিশ্বাসী ছিলেন না। সমগ্র জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে অহিংস হতে পারে বলে তিনি আশা করেন নি। তাঁর ধারণা ছিল যে, অহিংস নীতির প্রাধান্যের ভিত্তিতে কোন সমাজ গঠন করা সম্ভব এবং তার জন্যই তিনি সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আদর্শ অহিংস সমাজ এবং মানব প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধনে অহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে কাম্য সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন।
রাষ্ট্রের ন্যূনতম কার্যাবলীতে বিশ্বাস: আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তার ভিত্তিতে গান্ধীজী রাষ্ট্রের ওপর ন্যূনতম কাজের দায়িত্ব অর্পণের কথা বলেছেন। ডেভিড থরোর অনুকরণে তিনি বলেছেন, “আমি সেই সরকারকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি যা কম শাসন করে”। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল সমাজকল্যাণ; সুতরাং রাষ্ট্র তার কাজ পরিচালনায় এই মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সর্বাপেক্ষা কম শক্তি বা বলপ্রয়োগ করবে। জনসাধারণই হল মূল, রাষ্ট্র হল ফল। মূলে মিষ্টতা থাকলে ফল মিষ্ট হতে বাধ্য। সুতরাং অহিংস রাষ্ট্রের কার্যাবলী হবে ন্যূনতম। গান্ধীজীর আদর্শ সমাজে অপরাধের কোন অস্তিত্ব থাকবে না, তা তিনি বলেন নি। অহিংস রাষ্ট্র অপরাধীর মানসিক পরিবর্তনের ওপরই প্রাধান্য দেবে। অবশ্য বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টির সমাজ-বিরোধী প্রবণতা রোধ করবার অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে।
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা: গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তার পিছনে তাঁর মহান জাতীয়তাবাদী মনোভাব সক্রিয়, অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু গান্ধী হিংসাত্মক ও আগ্রাসমূলক জাতীয়তাবাদকে কখনও সমর্থন করেন নি। এই দৃষ্টিতে গান্ধীজী আন্তর্জাতিকতার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। জাতিবিদ্বেষ নয়, সুস্থ জাতীয়তাবোধের মাধ্যমেই সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব। গান্ধীজী জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বিশ্ব-রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের কথা বলেছেন।
সমালোচনা (Criticism)
গান্ধীজীর রাষ্ট্র-সম্পর্কিত চিন্তাধারাকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়ে থাকে।
(১) রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র উপেক্ষিত: রাজনৈতিক সমস্যাকে ধর্মীয় ও নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার করে গান্ধীজী তাঁর মত প্রচার করেছিলেন। তার ফলে গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তা বিশেষ, অস্পষ্ট বলে সমালোচনা করা হয়। মার্কসীয় লেখকগণের মতে, রাষ্ট্র শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র—এই মৌলিক সত্য গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় উপেক্ষিত হয়েছে। সমাজের অর্থনৈতিক দিক হতে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ নিজস্ব শ্রেণী-স্বার্থেই ব্যবহার করে, ব্যাপক কল্যাণের জন্য নয়—রাষ্ট্রের এই শ্রেণী-চরিত্র অস্বীকার করে গান্ধীজী বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণের দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থন করেছেন।
(২) সমাজ পরিবর্তনে অহিংস আন্দোলন সঠিক পন্থা নয়: গান্ধীজী অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলন পরিচালনার কথা বলেছেন। বিপ্লবী কর্মপন্থা ও বিপ্লবী আন্দোলনকে গান্ধীজী নিন্দা করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গী ঐতিহাসিক বিচারে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে সমালোচনা করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বুর্জোয়া শাসকগণ কোথাও বলপ্রয়োগ ছাড়া ক্ষমতা ত্যাগ করে নি। অহিংস আন্দোলন বা বিবেকের নিকট আবেদন শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় নি।
(৩) রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র স্ব-বিরোধী: গান্ধীজীর আদর্শ সমাজ ‘রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র’ ধারণাটিও সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। গান্ধীজী একদিকে রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, আবার অপরদিকে রাষ্ট্রের ন্যূনতম কার্যাবলী, সমাজকল্যাণের লক্ষ্য পূরণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অপরাধ-প্রবণতা হ্রাস, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর ধারণার মধ্যে সুস্পষ্ট বিরোধিতা রয়েছে।
(৪) রামরাজ্য কল্পলোকের বিষয়—অবাস্তব: গান্ধীজীর পরিকল্পিত সত্য ও অহিংসাভিত্তিক আদর্শ সমাজ ও রামরাজ্য বর্তমান জগতে নিতান্তই অবাস্তব। ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করে গান্ধীজী বাস্তব অবস্থা উপেক্ষা করেছেন। এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সম্পর্কে গান্ধীজী নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাস্তবে দেখা যায় যে, গান্ধীজীর আদর্শ ‘স্বপ্নের ভারত’ আজও সার্থক হয়নি।
(৫) সমাজ বা রাষ্ট্র অপেক্ষা ব্যক্তিতে গুরুত্ব আরোপ: গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় সমাজ বা রাষ্ট্র অপেক্ষা ব্যক্তির ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ব্যক্তির নৈতিক স্বাধীনতার উপলব্ধির কথা গান্ধীজী বলেছেন, কিন্তু তা সমাজ বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ হতে পারে না। সমাজের সভ্য হিসাবে এবং রাষ্ট্রের সহায়তায় ব্যক্তিজীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। এই দৃষ্টিতেও গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।