শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত গ্রন্থকে বলে পাঠ্যপুস্তক। পুস্তক পাঠ করা শিক্ষাজীবনে একটি প্রধান বিষয়। পুস্তক পাঠ দ্বারা নিজমনের বিকাশ সাধন করা যায়। জীবনের সঙ্গে পুস্তক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইতিহাস পুস্তক জীবনেরই একটি রূপ। ইতিহাস শিক্ষক হলেন প্রাণবন্ত কিন্তু ইতিহাস পুস্তক হল প্রাণহীন উপকরণ মাত্র। ভারতীয় ইতিহাসবিদ V. D. Ghate বলেছেন, ‘The history teacher is a living person while the history text book is only a thing.’.
ইতিহাস পুস্তক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জীবনেই প্রয়োজন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রয়োজনের হাতিয়ার, সব সময়ের সঙ্গী হল ইতিহাস পুস্তক। ইতিহাস পুস্তক হল ইতিহাস শিক্ষকের মুদ্রিত রূপ।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক অপেক্ষা বেশি নির্ভরশীল পাঠ্যপুস্তকের উপর। তাই ইতিহাসের পাঠক্রম নির্ধারণ করার পর পাঠ্যপুস্তক এমনই রচিত হওয়া উচিত যা থেকে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ই লাভবান হয়। পাঠ্যপুস্তককে সাধারণত শিক্ষার মূল বা প্রাথমিক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। প্রথম দিকে পাঠ্যপুস্তককেই জ্ঞানের একমাত্র মুদ্রিত আধার হিসাবে গ্রহণ করা হত এবং শিক্ষকগণ একমাত্র পাঠ্যপুস্তক অনুসরণকেই তাঁদের দায়িত্বের চূড়ান্ত মাত্রায় পালন মনে করতেন অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তককেই একমাত্র প্রামাণ্য হিসাবে গ্রহণ করা হত।
পরবর্তী কালে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও অনেক সহায়ক উপাদানের ব্যবহার সামগ্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করেছে, তবুও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার বা উপযোগিতা এতে কোনো অংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়নি।
অন্যান্য বিষয়ের মতো ইতিহাস বিষয় শিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাঠ্যপুস্তক যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন, ইতিহাস শিক্ষণের ক্ষেত্রে যতখানি সম্ভব পাঠ্যপুস্তক ব্যবহৃত না হওয়াই সমীচীন। আবার Johnson প্রমুখ শিক্ষাবিদ ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের পক্ষেই রায়দান করেছেন। অবশ্য বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই দুই মতবাদের কোনো একটি এককভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তককে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করাই অনেক বেশি শ্রেয়। তবে শুধুমাত্র পঠনীয় বিষয় হিসাবে নয়। ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস জ্ঞানবর্ধনের মাধ্যম হিসাবেই ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার হওয়া উচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যের সুচারু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক এই দায়িত্ব পালনের উপযোগী হতে পারে।
১৯৬৪ সালে কোঠারি কমিশন শিক্ষার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক সম্বন্ধে তাঁদের মতামত পোষণ করে বলেছেন, “A modern educational system without a Text-book is as difficult to imagine as Hamlet without the prince of Denmark.”।
ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক থেকে তত্ত্ব গ্রহণ করে, বিচারবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করা যায়। ইতিহাস আমাদের কাছে অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র রচনা করে চলেছে। অতীত ও বর্তমানের সমস্ত ঘটনাবলি ইতিহাসই আমাদের প্রদান করে। ইতিহাস পাঠ করে শুধু আমাদের শিক্ষাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না শিক্ষার ভিত্তিও পাকাপোক্ত হয় এবং জ্ঞানের বুনিয়াদ হয় সুদৃঢ়। ইতিহাস আমাদেরকে এক সম্পূর্ণতা দান করে। ইতিহাসের মধ্য দিয়ে একরকম বিশ্লেষণী ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। ইতিহাস পুস্তকের মাধ্যমে অতীত আমাদের চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগসূত্র রচিত হয়। সুতরাং যে পুস্তক পাঠ করে আমাদের জ্ঞান, চাহিদা প্রভৃতি মেটাতে পারি তা যেন সর্বাঙ্গসুন্দর ও সুষ্ঠু হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার একটি বিশেষ অঙ্গ হল সার্থক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন।
ভালো ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের বৈশিষ্ট্য (Features)
(১) ইতিহাসের প্রচ্ছদপট যেন মনোরম হয়। বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থ ও ভাব যেন প্রচ্ছদপটে পরিস্ফুট থাকে। তা যেন শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় হয়। কারণ পুস্তকের বহিরাবরণ পুস্তক প্রেমিকের চিরন্তন আনন্দের উৎস।
(২) ইতিহাস পুস্তকের বর্ণনা হবে সুন্দর ও সুললিত। অবাস্তব অর্থ দ্বারা যেন ভারাক্রান্ত করা না হয়। শিক্ষার্থীদের নিকট তা বোধগম্য হয় না। নির্বাচিত শব্দগুলি ছাত্রের বয়ঃস্তরের উপযোগী হবে। অবাস্তব জটিল শব্দ পরিহার করা উচিত।
(৩) প্রয়োজনের বেশি তত্ত্ব দ্বারা বইটি ভরানো চলবে না, অর্থাৎ তত্ত্বের বোঝা না বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনীয় তথ্যের সম্প্রসারণ ও উপযুক্ত পরিবেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) ইতিহাস বইতে যত ছবি দেওয়া হবে তত ভালো, তবে ছবিগুলি যেন কাল্পনিক না হয়। ছবিগুলি হবে যথাযথ ও আকর্ষণীয়।
(৫) ইতিহাস পুস্তকে ঐতিহাসিক উৎস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।
(৬) প্রয়োজন অনুসারে গান, ছড়া ও নকশা বইতে দেওয়া যেতে পারে।
(৭) সময়রেখা (Time line) দ্বারা যদি বইটিতে বোঝানো হয় তা হলে বিষয়বস্তুটি বুঝতে সহজ হবে এবং কম কথায় অনেক ভালো বোঝানো যাবে।
(৮) ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক এমন হতে হবে যেন পাঠ্য বিষয়সমূহের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ বজায় থাকে।
(৯) প্রতিটি অধ্যায়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যা বা বর্ণনা থাকবে। শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন বিষয় সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ইতিহাস বইটিতে যথেষ্ট সংখ্যক মানচিত্র, তালিকা, লেখচিত্র, সময়তালিকা ইত্যাদির ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে।
(১০) ইতিহাসের লিখিত বিষয় যেন নিরপেক্ষ হয়। অর্থাৎ কোনো লেখা যেন পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
(১১) পাঠ্যপুস্তকে সময়ানুক্রম অনুসারে বিষয়গুলি পরিবেশিত হবে।
(১২) প্রত্যেক পরিচ্ছেদে শিরোনাম থাকবে।
(১৩) ইতিহাস পুস্তকে বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে অর্থাৎ প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি বিষয়গুলি পড়ানোর জন্য অবশ্যই মানচিত্র থাকবে।
(১৪) প্রতি অধ্যায়ের শেষে প্রশ্নের অনুশীলনী থাকবে। প্রশ্নগুলি যাতে স্বয়সম্পূর্ণ, যথাযথ ও সত্যানুসন্ধানী হয় তার দিকে নজর দিতে হবে।
(১৫) অধ্যায়ের শেষে সংক্ষিপ্তসার যোগ করে দিলে খুব ভালো হয়।
(১৬) বইয়ের শেষে বাৎসরিক ও মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নগুলির নমুনা দেওয়া উচিত।
(১৭) পুস্তকের শেষে গৃহকাজের নমুনা দেওয়া ভালো।
(১৮) প্রত্যেক বিষয়ের ওপর সমধর্মী কিছু পুস্তকের (Collateral Reading) নাম দেওয়া ভালো।
(১৯) সময়, কাল ও যুগ অনুযায়ী বিষয়বস্তুর পরিবেশন হওয়া উচিত।
(২০) তারিখ, সাল প্রভৃতির যেন উল্লেখ থাকে তার দিকে নজর দিতে হবে।
(২১) ডায়াগ্রামের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা উচিত।
(২২) ইতিহাস লেখকের লেখায় যথেষ্ট সাহিত্যিক আবেদন থাকা চাই। আবেদন হবে মর্মস্পর্শী। ইতিহাস নীরস বিষয়। একে মাধুর্য দান করে সাহিত্য। ইতিহাস বিষয়ের ওপর গভীর জ্ঞান, ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসা, সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি ইতিহাস রচনার ভার নিলে তবে ইতিহাস আদর্শ সাহিত্যরূপে রচিত হতে পারে।
(২৩) ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে যেন মানুষের কাহিনির প্রকৃত ব্যাখ্যা করা হয়।
(২৪) পাঠ্যপুস্তকে নির্ঘণ্ট অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকে প্রায়ই নির্ঘণ্ট থাকে না।
(২৫) শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ইতিহাস বইটির বাহ্যিক চেহারা নয়নলোভন হতে হবে। মুদ্রণে অশুদ্ধি থাকা চলবে না, মুদ্রণের কাজটি পরিচ্ছন্ন হবে।
ভালো পাঠ্যপুস্তকের সুবিধা (Advantages)
(১) একটি ভালো পাঠ্যপুস্তকে উন্নত গঠনশৈলী যেমন—গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়সূচি, প্রশ্নাবলি, অনুশীলনী, মানচিত্র ও ছকের ব্যবহার, ছবির ব্যবহার—ইত্যাদির উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে সক্ষম হতে পারে।
(২) ভালো পাঠ্যপুস্তক তার উন্নত রচনাশৈলীর সাহায্যে শিক্ষার্থীদের বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে এবং এইভাবে শিক্ষার্থীদের বিষয়গত দক্ষতাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে।
(৩) নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে গৃহীত তথ্যাবলি উন্নত ও যুক্তিবদ্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে বিষয়বস্তু সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে। এ ছাড়া একটি ভালো পাঠ্যপুস্তক যে-কোনো বিষয়ে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য যথাযথভাবে পরিবেশন করে শিক্ষার্থীদের ধারণা গঠনে সহায়তা করতে পারে।
(৪) বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক জ্ঞানসমূহের কীভাবে ব্যাবহারিক প্রয়োগ করা যায় সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি দিয়ে একটি ভালো পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারে।
(৫) একটি ভালো পাঠ্যপুস্তক একদিকে যেমন শিক্ষককে উন্নততর ভাবে শিক্ষাদান করতে সহায়তা করতে পারে আবার তেমনি অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় শিখতে সহায়তা করতে পারে।