ইতিহাস পাঠদানের ক্ষেত্রে আবিষ্কার পদ্ধতি একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। কারণ, ইতিহাসের বহু তথ্য আমাদের কাছে অপ্রত্যক্ষ ও অতীত। সেজন্য বহু বিষয় সম্বন্ধে সন্দেহ ও মতদ্বৈধতা আছে। বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত নয়, কারণ ঐতিহাসিকের সিদ্ধান্তকে অন্ধভাবে মেনে নেওয়ার অর্থ পরবর্তীকালে বিচার না করে পরের মতকে মেনে নেবার প্রবণতাকে উৎসাহিত করা। ছাপা অক্ষরে লিখিত বিষয়কে নির্বিচারে মেনে নেওয়ার অর্থ হল, আত্মনির্ভরতার বদলে পরনির্ভরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। ইতিহাসের বহু তথ্যের মধ্যে সত্য-মিথ্যা, সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতা আছে। এগুলি যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। এজন্য ছাত্রদের মধ্যে বিচার বিশ্লেষণের দক্ষতা সৃষ্টি করা দরকার। শিক্ষকের নির্দেশ মতো শিক্ষার্থী পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। তাই শিক্ষাদানের এই প্রণালীকে ‘আবিষ্কার পদ্ধতি’ (Heuristic Method) নামে অভিহিত করা হয়। ‘Heuristic’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘Eureka’ শব্দ থেকে। Eureka কথাটির অর্থ ‘সত্য আবিষ্কারের আনন্দ’। বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস আবিষ্কারের সফলতায় ‘ইউরেকা’ অর্থাৎ ‘পেয়েছি, পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে আনন্দে চিৎকার করেছিলেন।
আবিষ্কার পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য (Features)
(১) শিক্ষার্থীগণ বিভিন্ন তথ্য থেকে নিজের চেষ্টায় ইতিহাসের তথ্য আবিষ্কার করতে সমর্থ হবে। নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধিৎসাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা সত্যকে জানবার চেষ্টা করবে।
(২) আবিষ্কার পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে হবে। এর ফলেই প্রকৃত জ্ঞানলাভ হবে, আত্মপ্রত্যয় ও বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার সৃষ্টি হবে।
(৩) সক্রিয়তাই বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা ও জ্ঞানলাভে সাহায্য করবে। সক্রিয়তাই আবিষ্কার পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক John Dewey বলেছেন, “চিন্তার বিপরীত দিক হল জড়তা। এই জড়তা শুধু অকৃতকার্যতার লক্ষণ নয়—বিচারশক্তি ও অনুধাবনের ক্ষমতাকে পঙ্গু করে, ঔৎসুক্যকে খর্ব করে, মনকে নির্বিকার ও জ্ঞানলাভের কর্মকে নিরানন্দময় করে।” আবিষ্কার পদ্ধতির মূলকথা হল চিন্তা, বিচারশক্তি, অনুসন্ধিৎসা ও আনন্দ সৃষ্টি করা।
(৪) শিক্ষাবিদ Rai Burne বলেছেন, “আবিষ্কার পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী নিজ নিজ প্রচেষ্টায় নতুন পথের সন্ধান করে এবং সমূহ ব্যাপারে অগ্রসর হয়।”
(৫) আবিষ্কার পদ্ধতিতে প্রথমে একটি বিষয় ঠিক করতে হবে, তারপর ওই বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করবে। গভীর চিন্তার ফলে বিচারবোধ সৃষ্টি হবে। এর থেকে জানার আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি হবে এবং সত্যে উপনীত হওয়ার সুখানুভূতি লাভ করবে।
উপসংহার (Conclusion)
আবিষ্কার করার মধ্যে রহস্য সন্ধানের যে বীজ প্রোথিত যা মানুষকে বারংবার নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে, উত্তর খুঁজতে অনুপ্রাণিত করেছে, মানুষের সেই স্বতোৎসারিত রহস্যসন্ধানী মনের পরিচয় মানবজনমের ধারার শুরুতেও যেমন ছিল তেমনি বর্তমানেও রয়েছে। প্রাচীন যুগে পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মধ্য দিয়ে আগুনের অবিষ্কারের ধারা পেয়ে আধুনিক যুগে মানুষ কম্পিউটারের মতো বিশেষ আবিষ্কারে পৌঁছেছে। আধুনিক মানুষ অনেক অনেক বেশি কৌতূহলোদীপ্ত হয়ে নানা আবিষ্কারের নেশায় প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আবিষ্কার পদ্ধতি কোনো পৃথক পদ্ধতি নয়, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি নীতি বা প্রণালী। এখানে শিক্ষার নীতি খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটি একটি ব্যক্তিভিত্তিক পদ্ধতি। কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধিৎসার সাহায্যেই তথ্য ও সত্য আবিষ্কার হয়। আবিষ্কার পদ্ধতি থেকে আরও নানাবিধ পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে। যেমন—প্রয়োগশালা পদ্ধতি (Laboratory Method), উৎস পদ্ধতি (Source Method) ও ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Method)।