ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে হোমরুল আন্দোলন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন দিশেহারা ও লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং চরমপন্থী ও নরমপন্থী বিবাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও তার রাজনীতিকে দুর্বল করেছিল, ঠিক তখনই সংগ্রামশীল সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি হোমরুল আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাল গঙ্গাধর তিলক ও শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত আয়ারল্যান্ডের হোমরুল আন্দোলনের প্রবর্তক জন রেডমন্ডের আদর্শ অনুকরণ করে ভারতে নব আন্দোলনের সূচনা করেন।
হোমরুল আন্দোলনের উদ্দেশ্য
‘হোমরুল’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘স্বায়ত্তশাসন’। তবে এর প্রকৃত অর্থ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এক দায়িত্বশীল সরকার গঠন করা। ভারতের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরে ভারতীয়দের পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করা।
হোমরুল আন্দোলনে অ্যানি বেসান্তের অবদান
থিওসোফিক্যাল সোসাইটির কর্ণধার শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায় মাদ্রাজের আদিয়ারে ‘হোমরুল লিগ’ গঠন করেন। তিনি মনে করতেন যে, ভারতীয়রা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দক্ষতা অর্জন না করলে ভারতবর্ষের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। অ্যানি বেসান্ত ‘কমন উইল’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় বলেন যে, ভারতকে স্বশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে নরমপন্থী-চরমপন্থী গোষ্ঠীর মিলন অপরিহার্য।
জওহরলাল নেহরু, যমুনালাল বাজাজ, শঙ্করলাল ব্যাংকার প্রমুখের প্রচেষ্টায় বেসান্তের ‘হোমরুল লিগ’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অচিরেই ২০০টির ওপর লিগ শাখা কার্যালয় গড়ে ওঠে। তবে কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ নেতারা কেউই হোমরুল আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না।
হোমরুল আন্দোলনে তিলকের অবদান
বাল গঙ্গাধর তিলক চরমপন্থী মনোভাব থেকে দূরে সরে এসে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল বেলগাঁওতে অনুষ্ঠিত বোম্বাই প্রভেনসিয়াল কনফারেন্সে তাঁর ‘হোমরুল লিগ’ গঠনের কথা প্রকাশ করেন। জনসাধারণকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে, “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমাকে তা অর্জন করতেই হবে।” (Swaraj is my birth right and I must have it).
বাল গঙ্গাধর তিলক ‘মারাঠী’ ও ‘কেশরী’ পত্রিকায় হোমরুল আন্দোলনের স্বপক্ষে প্রচার চালিয়ে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। বাল গঙ্গাধর তিলকের লক্ষ্য ছিল, স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, জাতপাতহীন প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্ব স্থাপন। তিনি মনে করতেন যে, পার্থক্য ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণে নয়, পার্থক্য হল শিক্ষিতে ও অশিক্ষিতে।
বাল গঙ্গাধর তিলকের গড়ে তোলা হোমরুল লিগের সম্পাদক ছিলেন এন. সি. কেলকার ও সভাপতি ছিলেন যোসেফ ব্যাপ্তিস্তা। বাল গঙ্গাধর তিলক গ্রামের মানুষের নিকট ‘লোকমান্য’ নামে পূজিত হন। অ্যানি বেসান্ত ও বাল গঙ্গাধর তিলকের উদ্দেশ্য এক হলেও দুটি ‘হোমরুল লিগ’ কোনোদিন একত্র হয়ে যায়নি।
সরকারী প্রতিক্রিয়া
‘হোমরুল আন্দোলন’ ক্রমশ বিস্তার লাভ করলে ব্রিটিশ সরকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সমগ্র দেশে হোমরুল আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই বাল গঙ্গাধর তিলককে গ্রেপ্তার করে ২০০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। অ্যানি বেসান্তকেও নজরবন্দি করা হয়। গান্ধিজি ও জিন্না এই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। শেষ পর্যন্ত জিন্নার সুযোগ্য ওকালতির ফলে বাল গঙ্গাধর তিলক ছাড়া পান। জাতীয় কংগ্রেসে তিলকের সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
হোমরুল আন্দোলনের গুরুত্ব
প্রথমত, হোমরুল আন্দোলন রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধিতে দেশের সর্বত্র সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। নরমপন্থী-চরমপন্থী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কৃষক-শ্রমিক, উচ্চ-নীচ, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ হোমরুল আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। প্রতিটি ভারতীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, হোমরুল আন্দোলন থেকে উদ্ভুত স্বায়ত্তশাসনের দাবি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে প্রভাবিত করেছিল, যার পরিপূর্ণতা লক্ষ করা যায় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে। হোমরুল আন্দোলনের ফলেই ভারত সচিব মন্টেগু ঘোষণা করতে বাধ্য হন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক থেকে ভারতীয়রা যাতে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে, তার জন্য ব্রিটিশ সরকার সেই নীতিই গ্রহণ করবে।
তৃতীয়ত, মূলত হোমরুল আন্দোলনের চাপেই পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন পাস করে।
চতুর্থত, হোমরুল আন্দোলনের সূত্র ধরেই গান্ধিজি ভারতীয় রাজনীতির শিখরে উঠে আসতে পেরেছিলেন। গান্ধিজির জনপ্রিয়তার চালচিত্র তৈরিতে হোমরুল আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। হোমরুল আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই গান্ধিজির উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। গান্ধিজির জীবনীকার জুডিথ ব্রাউন বলেছেন, “The Home Rule Leagues began in a halting fashion that Gandhiji was later to adopt boldly and with far greater success.”