প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জনগণের সমর্থনে ভাইমার সরকারের শাসনকার্য চলতে থাকে। কিন্তু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে আমেরিকা জার্মানিকে অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেয়। ফলে, জার্মানিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে। এই সময় জার্মান জাতির মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে হিটলার ও তাঁর ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি (Nazi) জার্মানির রাজনীতিক্ষেত্রে প্রবেশ করে। জার্মান ভাইমার প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতাই হিটলারের অভ্যুত্থানের পথ উন্মুক্ত করে।
হিটলারের বাল্যজীবন
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার এক সাধারণ চর্মকারের ঘরে এডলফ হিটলার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন অস্ট্রিয়ার শুল্ক বিভাগের একজন সাধারণ কর্মচারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মান নাগরিক না হয়েও তিনি জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং সৈনিক হিসাবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় তাঁকে গভীর শোকে নিমগ্ন করে এবং তাঁর মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। এই সময়েই তিনি রাজনীতিকের পেশা অবলম্বন করেন এবং কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে একটি উৎকট জাতীয়তাবাদী দল বা ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট’ দল গঠন করেন। এই দলটিই ইতিহাসে ‘নাৎসি দল’ নামে খ্যাত।
হিটলারের কর্মসূচি
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর হিটলার তাঁর দলের সাহায্যে জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তিনি দু-বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। কারাকক্ষে বসেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মেইন ক্যাম্ফ’ (Main Kampf) রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ইউরোপীয় জাতিবর্গের অবিচার, প্রতিহিংসা ও জার্মানির দুর্দশার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। এই গ্রন্থটিকে ‘নাৎসি বাইবেল’ বলা হয়। হিটলার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল অস্ট্রিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
হিটলারের ক্ষমতালাভ
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে হিটলার নাৎসি দলের সংগঠন ও সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করার ব্যাপারে নাৎসি দলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নাৎসি দল ভার্সাই চুক্তি প্রত্যাখ্যান, অর্থনীতি শক্তিশালী ও বেকারদের চাকুরীদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়াতে থাকে। ফলে শিক্ষিত বেকার তরুণ, জার্মান বণিক সম্প্রদায় ও কৃষকরা হিটলার ও তাঁর দলকে আন্তরিক সমর্থন জানায়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবার্গ পুনরায় নির্বাচনপ্রার্থী হলে হিটলার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়ান। হিটলার নিজে পরাজিত হলেও তাঁর দল ১০৭টি আসন লাভ করে আইনসভায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ফলে জার্মান পার্লামেন্টে (রাইখস্ট্যাগের) সমস্ত আইন প্রণয়নে তিনি সার্থকভাবে বাধা দিতে সমর্থ হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবুর্গ নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারকে প্রধানমন্ত্রী বা চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে বাধ্য হন। হিটলার চ্যান্সেলর হয়ে ভাইমার সংবিধানের ৪৮নং ধারা প্রয়োগ করে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সংবিধান ও পার্লামেন্ট মূলতুবী করেন। এর ফলে হিটলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গের মৃত্যুর পর হিটলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলার দুই পদই গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের দমন করে জার্মান রাষ্ট্রের সর্বাত্মক ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর উপাধি হল ‘ফুরার’ (Fuhrer) অর্থাৎ সর্বোচ্চ নেতা। এইভাবে জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে এবং নাৎসি দল ও হিটলারের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূল্যায়ন
নাৎসিদলের ক্ষমতালাভের মূলে হিটলারের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অবদান অনস্বীকার্য। জার্মানির রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক দুর্দশার সুযোগ নিয়ে তিনি ক্ষমতালাভে সমর্থ হয়েছিলেন। অনেকের মতে, ভার্সাই সন্ধি যেভাবে জার্মান জাতির আত্মমর্যাদায় আঘাত হেনেছিল তা জার্মানদের মধ্যে প্রতিশোধাত্মক মনোভাবের সঞ্চার করে। হিটলার সেই সুযোগ নিয়ে জার্মান জাতিকে হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সন্ধান দেন। জাতীয়-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জার্মানরা যে বলিষ্ঠ নেতার প্রতীক্ষায় ছিলেন হিটলার তা পূরণ করেন