গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের চেয়ারম্যান হিসাবে মাও জে দং তাঁর প্রথম দিনের ভাষণে বলেছিলেন—”আমরা আমাদের নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করতে এবং বিশ্বশান্তি ও মুক্তির জন্য সাহসিকতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করব।” কমিউনস্ট পার্টির নেতৃত্ব ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীর সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা চীনের মানুষের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্র বিরোধী “নয়া গণতান্ত্রিক” বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করেছিল।
সাফল্যের কারণ (Reasons for Success)
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল বিভিন্ন কারণে—
- মাও জে দং খুবই নির্মম হাতে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রেখে, কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন।
- সোভিয়েত রাশিয়া অনুদানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিল।
- চিনাদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ এবং তাদের আত্মত্যাগ চিনের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করেছিল।
শিল্পের বিকাশ (Development of Industry)
উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণে দশ বছরের মধ্যেই চিন প্রধান প্রধান শিল্পে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বড় শিল্প গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ৫৮.২ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল। যেমন— ১৯৫৭-এর মধ্যে ইস্পাত উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছিল, ১৯৬০-এ চীন কয়লা উৎপাদনে ব্রিটেনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, কাপড় কলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইসব কিছুই সম্ভব হয়েছিল চিনের শিল্প শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য এবং তার জন্য কোনো বাড়তি মজুরি দাবি না করার জন্য। চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই শ্রমিকদের বলেছিলেন যে, তারা যেন কিছু কষ্ট স্বীকার করে, যাতে শেষাবধি আমাদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং শান্তিতে থাকতে পারি।
কৃষির বিকাশ (Development of Agriculture)
গ্রামীণ বিকাশের ক্ষেত্রে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার কৃষি সংস্কার আইন (Agrarian Reform Law) প্রণয়ন করে। এই আইনে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ নির্ভর জমির মালিকানা ব্যবস্থার উচ্ছেদের কথা এবং বৃহৎ ভূস্বামীদের জমি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করে সেগুলি ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বণ্টনের কথা বলা হয়েছিল।
যে মুহূর্তে চীনে জমির বাজেয়াপ্তকরণ ও পুনর্বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, সে মুহূর্তে বৃহৎ ভূস্বামী ও ধনী কৃষকদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। তাদের জমি বলপূর্বক ক্রোক করে দরিদ্র কৃষক ও ভূমিহীন ভাড়াটে চাষীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। বহু অত্যাচারী ভূস্বামীকে সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতির (Summary trial) মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সনাতন চীনা সমাজের মেরুদণ্ড জেন্ট্রি শ্রেণীর অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে যখন কৃষি বিপ্লবের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়, তখন দেখা গেল ৭০০ মিলিয়ন মৌ (একর) জমি ৩০০ মিলিয়ন কৃষকের মধ্যে পুনর্বণ্টন করা হয়েছে।
কৃষি বিপ্লবের প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তির পর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সরকার যৌথ কৃষি ব্যবস্থার (Collectivisation of agriculture) দিকে পা বাড়ায়। যৌথ কৃষি ব্যবস্থা অনুযায়ী জমির ওপর কৃষকদের যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। যৌথ কৃষি ব্যবস্থার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে চীনের ৯৬ শতাংশ কৃষকই আধা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদক সমবায়গুলির সদস্য হয়েছিল। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চীনের প্রায় ৮ লক্ষ সমবায় খামারের (Co-operative farm) অস্তিত্ব ছিল। প্রতিটির মধ্যে গড়ে ১৬০টি পরিবারভুক্ত ৬০০ থেকে ৭০০ জন মানুষ ছিলেন। অবশ্য এই যৌথ ব্যবস্থা বা পরবর্তীকালের গণ কমিউন ব্যবস্থাতে কৃষির উৎপাদন তেমন ভালোভাবে হয়নি।
উপসংহার (Conclusion)
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন শিল্প ও কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রতিবন্ধকতাগুলিকে কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। তাই মাত্র দশ বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অরাজক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শক্তিধর দেশে চীন রূপান্তরিত হয়েছিল।