প্রাক-আধুনিক চীনের শাসন ব্যবস্থা (Administrative System of Pre-modern China) ছিল একটি জটিল এবং শ্রেণিবদ্ধ কাঠামো যা হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে স্থায়ী সভ্যতাগুলির একটিকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা (Central Administrative System)
প্রাক-আধুনিক চীনে ক্ষমতার সর্বোচ্চস্তরে ছিলেন চীন সম্রাট। চীনে সম্রাটের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা হত। সম্রাটকে বলা হত ‘স্বর্গের সন্তান’। প্রচলিত ধারণা অনুসারে তিনি প্রকৃতি ও মানব সমাজের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করতেন। স্বর্গের অনুশাসনের (তিয়েন মিং) মাধ্যমে তিনি এই কর্তৃত্ব অর্জন করেছিলেন। তবে স্বর্গের অনুশাসন অপরিবর্তনীয় ছিল না। রাজকর্মচারীদের দুর্নীতি এবং সম্রাটের অপদার্থতা প্রকট হয়ে উঠলে, সমাজের স্বার্থে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ করার সীমিত অধিকার চীনা ঐতিহ্যে স্বীকৃত ছিল। এধরনের ধ্যানধারণা কনফুসীয় ভাবধারার মধ্যে নিহিত ছিল।
চীনা শাসনতন্ত্রে সরকারি কর্মচারীদের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁদের বলা হত ‘ম্যান্ডারিন’ (Mandarin)। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তাঁরা সম্রাটের সঙ্গে স্বর্গের অনুশাসন লাভের অংশীদার ছিলেন। একজন ম্যান্ডারিনকে শাসনতান্ত্রিক বিষয় সম্পর্কে যত না জানতে হত, তার চেয়ে ধ্রুপদী চীনা ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর অধিকতর জ্ঞান বাঞ্ছনীয় ছিল। ম্যান্ডারিনকে একজন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার ছিল না। কাম্য ছিল তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হবেন।
১৩৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাল জনৈক মিং সম্রাট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তুলে দিয়ে সচিবালয় বা নেইকো প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল সচিবালয়। যাবতীয় রাজকীয় আদেশ এবং ঘোষণা সচিবালয় থেকেই জনসমক্ষে পাঠানো হত। চিং সম্রাট কাং-শির রাজত্বকালে সচিবালয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহাপরিষদ বা Grand Council গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয়ের গুরুত্ব কমে যায়। নতুন প্রতিষ্ঠান সচিবালয়ের যাবতীয় রাজনৈতিক এবং সার্বভৌম ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। যে সময় সচিবালয় থেকে ক্ষমতা মহাপরিষদের হাতে চলে যায় সে সময় চীনের সম্রাট ছিলেন ইয়ুং-চেং। এই মহাপরিষদের সদস্যরা সকলে ছিলেন সম্রাট ইয়ুং-চেং-এর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।
চীনে প্রাদেশিক সরকারগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে ৬টি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। এই ৬টি বোর্ডের সভাপতি ও সহ-সভাপতিরা মহাপরিষদের সদস্য হতেন। তাছাড়া অসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা মহাপরিষদের সদস্য থাকতেন। মহাপরিষদের সদস্যপদ ছিল পুরোপুরি অবৈতনিক। তবে তাঁরা তাঁদের মূলপদের জন্য বেতন পেতেন। মহাপরিষদের বার্ষিক খরচ ছিল ১০,৫০০ থেকে ১১,০০০ টেইল।
মহাপরিষদের সদস্যদের অধীনে ৩২ জন সচিব থাকতেন। এদের মধ্যে ১৬ জন চীনা এবং ১৬ জন মাঞ্চু। নিয়মিত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন সচিবেরা। সচিবদের ‘ক্ষুদে কাউন্সিলর’ (Little Councillor) বলা হত। চিং শাসনকালে ৩৪ জন সচিব মহাপরিষদের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।
সচিবালয় এবং মহাপরিষদের পরবর্তী স্তরে ছিল ৬টি বোর্ডের স্থান। এই ৬টি বোর্ড ছিল কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মেরুদণ্ড। এই বোর্ডগুলি ছিল অসামরিক প্রশাসনিক দপ্তর (লি-পু), রাজস্ব দপ্তর (হু-পু), যুদ্ধ সংক্রান্ত দপ্তর (পিং-পু), শাস্তিদান সংক্রান্ত দপ্তর (শিং-পু), জনকল্যাণ দপ্তর (কুং-পু) এবং আচার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত দপ্তর (লু-পু)। প্রতিটি বোর্ডে ২ জন সভাপতি এবং ৪ জন সহ-সভাপতি থাকতেন। চীনা ও মাঞ্চুদের মধ্যে পদগুলি সমানভাবে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বোর্ডের অধীনে ৪টি করে কেন্দ্র থাকত। কেবলমাত্র রাজস্ব দপ্তরের ১৪টি এবং শাস্তিদান সংক্রান্ত দপ্তরের ১৮টি কেন্দ্র ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন বৈদেশিক দপ্তর ছিল না। এর প্রধান কারণ ছিল যে, কনফুসীয় ধারণা অনুযায়ী চীনারা কোন দেশের সঙ্গে সমপর্যায়ে দাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতী ছিল না। তাই বৈদেশিক দপ্তর রাখার প্রয়োজনীয়তা চীনা কর্তৃপক্ষ অনুভব করেনি।
সচিবালয়, মহাপরিষদ এবং ৬টি বোর্ড এগুলি ছিল চীনের কেন্দ্রীয় শাসনের প্রধান অঙ্গ। কিন্তু এগুলি ছাড়াও কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষাকারী কার্যালয়ের অস্তিত্ব ছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চিং সেন্সরেট। চিং সেন্সরেটে ২ জন প্রবীণ সভাপতি, ৪ জন প্রবীণ সহ-সভাপতি, ২ জন নবীন সভাপতি এবং ৪ জন নবীন সহ-সভাপতি থাকতেন। ৬টি বোর্ডের অধীনে ২৪ জন সেন্সর ছিলেন, আর প্রদেশের জন্য ৫৬ জন সেন্সর থাকতেন। সেন্সরদের কাজ ছিল সরকারি কর্মচারীদের কাজকর্মের উপর নজরদারি করা। কেউ কর্তব্য কর্মে অবহেলা করলে, সেন্সররা তা সম্রাটের দরবারে জানিয়ে দিতেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল হানলিন অ্যাকাডেমি যা পড়াশোনা সংক্রান্ত। অ্যাকাডেমির ২ জন চ্যান্সেলর থাকতেন—১ জন চীনা এবং ১ জন মাঞ্চু। তাঁরা সম্রাটকে বিভিন্ন ধ্রুপদী সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান দান করতেন এবং সম্রাটের বক্তৃতা দেওয়ার বিষয় লিপিবদ্ধ করে দিতেন। হানলিন অ্যাকাডেমির অধীনে একটি চমৎকার গ্রন্থাগার ছিল। মূল্যবান পুস্তক ছাড়াও নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও স্মৃতিকথা এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকত। হানলিন গ্রন্থাগারের অধীনে রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিকের কার্যালয় ছিল। ঐতিহাসিকরা প্রত্যেক সম্রাটের রাজত্বকালের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতেন এবং রাজত্বকাল সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষিত রাখতেন। তাছাড়া ঐতিহাসিকরা সম্রাট, সম্রাজ্ঞী ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের জীবনীও লিখতেন। কেবলমাত্র মেট্রোপলিটন সাম্মানিক স্নাতকরাই অ্যাকাডেমির সদস্য হতে পারতেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন ভাল ছাত্র। অ্যাকাডেমিতে সাফল্যের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার পর অনেক সময়ই তাদের পদোন্নতি ঘটত। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উচ্চতম স্তরে অ্যাকাডেমির অনেক সদস্যই উন্নীত হয়েছিলেন।
মাঞ্চুদের শাসনকালে বিশেষ অপরাধের জন্য বিশেষ ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। বিচারকার্য পরিচালনার সময় সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। বিচার প্রার্থীদের মধ্যে কে সঠিক এবং কে ভ্রান্ত—সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া হত না। সামাজিক শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং সম্রাটের কর্তৃত্বের বিরোধিতা সব থেকে বড় অপরাধ বলে গণ্য করা হত। মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন ছিল। এর পরবর্তী স্তরের শাস্তি ছিল নির্বাসন। শাস্তি হিসাবে দৈহিক অত্যাচার স্বীকৃত ছিল। নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার বিষয়টির থেকে সমাজের কল্যাণের দিকে অধিকতর নজর রেখে চীনে আইন ও দণ্ডব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছিল। তবে নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দায়ের করার অধিকার ছিল।
প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা (Provincial Administrative System)
চিং শাসনকালে চীনদেশ ১৮টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলি ৯২টি সার্কিটে বিভক্ত ছিল। সার্কিটগুলি বিভক্ত ছিল ১৭৭ থেকে ১৮৫টি প্রিফেক্চারে। আবার প্রিফেচারগুলি বিভক্ত ছিল প্রায় ১৫০০ জেলা ও ডিপার্টমেন্টে। ১৮টি প্রদেশের শাসনের দায়িত্বে থাকতেন গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরেরা। গভর্নর জেনারেলের কাজে সাহায্য করতেন গভর্নরেরা। যদি কোন প্রদেশের গভর্নর জেনারেল মাঞ্চু হতেন, তবে সেই প্রদেশের গভর্নর অবশ্যই একজন চীনা হতেন। আবার অন্য ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটা ঘটত। অষ্টাদশ শতকের অন্তিম লগ্নে শতকরা ৫৭ জন গভর্নর জেনারেল ছিলেন মাঞ্চু এবং শতকরা ৪৩ জন ছিলেন চীনা।
প্রত্যেক গভর্নরের অধীনে একজন করে অর্থসংক্রান্ত, বিচারবিভাগীয় এবং শিক্ষানীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিশনার থাকতেন। তাঁদের সকলকে নিযুক্ত করতেন সম্রাট স্বয়ং। প্রত্যেক কমিশনারের অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করত সরকার। তবে তাঁদের বেশ কিছু ব্যক্তিগত কর্মচারী ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে লবণ বাণিজ্য, শস্য পরিবহন, আবগারি, নদীপথে যাতায়াত ইত্যাদি বিষয় দেখাশোনা করার জন্য সরকার একদল বিশেষ কমিশনার নিযুক্ত করত। একজন প্রাদেশিক সৈন্যাধ্যক্ষ এলাকার সামরিক বিষয়গুলির তত্ত্বাবধান করতেন।
প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কমিশনারদের পরবর্তী স্তরে ছিল সার্কিট ইনটেনডেন্ট (Circuit Intendent) ও প্রিফেক্ট (Prefect)। সার্কিট ও প্রিফেক্চারের পরবর্তী ক্ষুদ্রতর একক ছিল জেলা। জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল জেলা শাসকদের ওপর। জেলা শাসকদের কাজ ছিল কর আদায় করা, মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা এবং এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। জেলা শাসককে বলা হত ‘ফু-সু কুয়ান’ বা ‘বাপ মা পদাধিকারী’ (Father- mother official)। জেলাশাসকদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রেখে চলতে হত এবং তাদের চাহিদার প্রতি নজর রাখতে হত বলে সম্ভবত তাদের উক্ত নামে ডাকা হত। স্থানীয় বিষয়ে ওয়াকিবহাল কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে জেলাশাসক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতেন। এই গোষ্ঠী বেসরকারি স্থানীয় আমলা হিসাবে কাজ করে জেলাশাসককে প্রশাসনিক কাজে সাহায্য করত।
প্রত্যেকটি জেলা আবার গ্রামে (চুয়াং), নগরে (চোং), শহরে (চেন), গ্রামভিত্তিক বসতি (শিয়াং) এবং গ্রামীণ বাজারে (শি) বিভক্ত ছিল। গ্রামীণ এককগুলির শাসনের দায়িত্বে থাকতেন স্থানীয় অধিবাসীরা। সরকারি কর্মচারীরা গ্রামীণ শাসনের দায়িত্বে থাকতেন না বললেই চলে। যেহেতু গ্রামীণ স্তরে স্থানীয় অধিবাসীরা শাসনের দায়িত্বে থাকতেন, সেহেতু গ্রাম, নগর ও শহরগুলি যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যিক সরকার আঞ্চলিক প্রশাসনে কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিল। ১৬৪৪ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত পাও-চিয়া পুলিশী ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত এবং ১৬৪৮ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত লি-চিয়া কর আদায়ে সাহায্য করত। পাও চিয়ার প্রধানকে বলা হত পাও-চাং। তারা এলাকার অপরাধমূলক ঘটনা এবং গুপ্ত ষড়যন্ত্রের খবর সংগ্রহ করতেন। গ্রামাঞ্চলে ১১০টি পরিবার নিয়ে একটি লি গঠিত হত। লি-চিয়ার প্রধানকে বলা হত লি-চাং। সাধারণত অধিক পরিমাণে করদাতা কোন বয়স্ক ব্যক্তিকে লি-চাং পদে নিযুক্ত করা হত। কর আদায়ের বাইরে তারা আদমসুমার প্রস্তুত করতেন এবং কর আদায়কারীদের নথিপত্র সংরক্ষিত রাখতেন।