রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্বন্ধে আদর্শবাদ প্রাচীন দার্শনিক ঐতিহ্যের অনুসারী প্রাধান্যমূলক মতবাদ। রাষ্ট্রকে আদর্শ তত্ত্বের ভিত্তিতে সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া আদর্শবাদী বা ভাববাদী মতবাদের মূলকথা। প্রাচীন গ্রীসের প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তায় আদর্শবাদী বা ভাববাদীর সন্ধান মেলে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলে গ্রহণ করেছিলেন। অ্যারিস্টটল বলেছেন, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের সহজ, সুন্দর, পূর্ণাঙ্গ বিকাশ রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব (“A man who lives outside society is either God or beast.” — Aristotle)। সমাজের মধ্যে বাস করেই ব্যক্তি তার জীবনকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারবে; সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব হবে।
আদর্শবাদী বা ভাববাদী তত্ত্বের মূল বক্তব্য
প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে পরবর্তীকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রকে নৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করেছেন। আদর্শবাদী বা ভাববাদী প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামাজিক প্রকৃতি সম্পর্কে প্রাচীন ধারণার সঙ্গে বর্তমান অবস্থার সামঞ্জস্য রক্ষার প্রচেষ্টা। রাষ্ট্র মানুষের স্বাভাবিক, অপরিহার্য, চূড়ান্ত সংগঠন। ইহা চরম ও সর্বাত্মক। রাষ্ট্র কোন অন্যায় করতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য আবশ্যিকভাবে স্বীকৃত। আদর্শবাদ রাষ্ট্রের ওপর দেবত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্রকে এক উচ্চ বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রাধীন সকল ব্যক্তিকে এই বেদীমূলে পূজা করতে নির্দেশ দেয় (“…Places the State upon a pedestal at the foot of which its members are expected to bow and worship it” — Garner)। রাষ্ট্রই হল সর্বোচ্চ নীতি, রাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পূর্ণ উপলব্ধি সম্ভব। রাষ্ট্রীয় সংগঠনের নিজস্ব ইচ্ছা আছে, অধিকার আছে, স্বার্থ আছে, ব্যক্তির ইচ্ছার সঙ্গে এর মিল নাও হতে পারে। রাষ্ট্র ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি ‘সাধারণ ইচ্ছা’র (general will) দ্বারা পরিচালিত। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের মতভেদে ‘সাধারণ ইচ্ছা’ই প্রাধান্য লাভ করবে, কারণ ব্যক্তি অপ্রকৃত ইচ্ছার (unreal will) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বলে স্বীকৃত হবে। সুতরাং আদর্শবাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্রই সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির মূল উৎস মঙ্গলময় আদর্শ জীবনের পূর্ণ প্রতীক।
জার্মান আদর্শবাদী বা ভাববাদীদের মতামত
আদর্শবাদ বলিষ্ঠ রূপলাভ করে জার্মান দার্শনিকদের হাতে। কান্ট (Kant), হেগেল (Hegel), ফিটে (Fichte) এবং হেগেল-শিষ্য ট্রিটসকে (Treitshke) ও বার্নহার্ডির (Burnhardi) রচনার আদর্শবাদ চরম মতবাদে পরিণত হয়। কান্ট নৈতিক প্রশ্নের নিরিখে রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব দর্শনের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। কান্ট রাষ্ট্রকে নৈতিক সত্ত্বা সমন্বিত মনে করতেন এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজের নৈতিক তাৎপর্য স্বীকার করেছেন। কান্ট অবশ্য রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অন্ধভাবে স্বীকার করেননি। হেগেলকে প্রকৃতপক্ষে আদর্শবাদের জনক বলে অভিহিত করা যায়। হেগেল রাষ্ট্রের ওপর দেবত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্র হল একটি সচেতন নৈতিক আদর্শসম্পন্ন সত্তা। রাষ্ট্রাধীন ব্যক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তাই প্রকৃত স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের বাইরে স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে পারে না। হেগেলীয় রাষ্ট্রদর্শনের মূলকথা হল, যা যুক্তিপূর্ণ তাই বাস্তব এবং যা বাস্তব তাই যুক্তিপূর্ণ। এভাবে হেগেলীয় দর্শনে রাষ্ট্র হল চরম ক্ষমতাসম্পন্ন নৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র শুধু সামাজিক নীতিবোধের প্রকাশ মাত্রই নয়, পৃথিবীতে ‘ঈশ্বরের পদক্ষেপ’ (march of God on earth)। রাষ্ট্রের সার্থকতা এর মধ্যেই নিহিত এবং ব্যক্তি রাষ্ট্রের সভ্য হিসাবেই আপন সার্থকতা খুঁজে পায়। হেগেল শিষ্য ট্রিটসকে ও বার্নহার্ডির হাতে আদর্শবাদ চরম মতবাদে পরিণত হয়। রাষ্ট্র শক্তির প্রতীক রাষ্ট্রের চরম প্রকাশে শক্তির প্রয়োগ বা যুদ্ধ অপরিহার্য। যুদ্ধ রাষ্ট্রের পক্ষে অন্যায় নয়, এবং ইহং রাষ্ট্রের মহান ও আবশ্যিক কর্তব্য।
রুশো ও ইংরেজ আদর্শবাদী বা ভাববাদীদের মতামত
অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো (Rousseau) তাঁর ‘সাধারণ ইচ্ছা’র (general will) ধারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সমাজজীবনের স্পৃহা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বলে গ্রহণ করেন। ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা সাধারণ ইচ্ছার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে যায়। ইংরেজ ভাববাদীগণ হেগেলের মতবাদ সম্পূর্ণ গ্রহণ করেন নি। ইংরেজ ভাববাদীগণের মধ্যে গ্রীণ, বোসাংকে ও ব্রাডলে বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। ইংরেজ দার্শনিক গ্রীণ (T.H. Green), প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, কান্ট ও হেগেলের দার্শনিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। গ্রীণ-কে আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদের জনক বলে অনেকে স্বীকার করেন। গ্রীনের মতে, মানুষের সচেতনতা রয়েছে, সুতরাং তার স্বাধীনতা প্রয়োজন। সেই স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব। ব্যক্তির কর্তব্য পালনের পথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা যাতে সৃষ্ট না হয়, সেই বিষয়ে লক্ষ রাখবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু গ্রীণ স্বীকার করেছেন যে রাষ্ট্র যদি কোন অন্যায় ভুল করে, তাহলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যে ব্যক্তির কর্তব্য হবে রাষ্ট্রকে বাধা দেওয়া। দার্শনিক বোসাংকে (Bernhard Bosanquet) রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা স্বীকার করেও রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সীমারেখা নির্দেশ করেছেন। রাষ্ট্র ব্যক্তিজীবনের বিকাশের পথে অন্তরায়গুলি দূর করার কাজে সচেষ্ট থাকবে, ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিবেশ গড়ে তুলবে। বোসাংকে হেগেলীয় ভাবধারা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ না করলেও রাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যক্তিকে বিসর্জন দেবার ধারণা স্বীকার করেন। দার্শনিক ব্রাডলে (F. A. Bradley) গ্রীন অপেক্ষা হেগেলীয় চিন্তাধারায় অধিক প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক সত্তা হিসাবে স্বীকার করেন। সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব স্থান আছে, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অবশ্য ইংরেজ ভাববাদিগণ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদেবতার বেদীমূলে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করতে চান নি।
সমালোচনাঃ
(১) সম্পূর্ণ বাস্তববর্জিত: আদর্শবাদীগণ রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সকল সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। মানুষের নৈতিক ইচ্ছা এবং মঙ্গলময় প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ে গঠিত যে রাষ্ট্রের কথা আদর্শবাদীগণ বলেছেন তা কল্পরাজ্যের রাষ্ট্র হতে পারে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত। আদর্শবাদী দৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অভিন্নতা কল্পনা করা হয় তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র ছাড়া নানা ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। সমাজস্থিত এ সকল সংগঠনের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে আদর্শবাদ বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন।
(২) মানব প্রবৃত্তির উপেক্ষাঃ আদর্শবাদ মানুষকে সুবুদ্ধির অধিকারী বলে গ্রহণ করে মানব প্রবৃত্তিকে উপেক্ষা করেছে। মানুষের আচরণের পিছনে যেমন নৈতিক চেতনা ও বিচারবোধ রয়েছে, তেমনি প্রবৃত্তির তাড়নাও রয়েছে। এ হিসাবে আদর্শবাদ ত্রুটিপূর্ণ।
(৩) স্বাধীনতার পরিপন্থী: আদর্শবাদী বা ভাববাদী ধারণায় দু’ধরনের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করা হয়—প্রকৃত ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অপ্রকৃত ইচ্ছা। প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি। সুতরাং ব্যক্তিগত ইচ্ছা কোন অবস্থায় প্রকৃত ইচ্ছার বিরোধী হতে পারে না। এ ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির মতবিরোধের কোন সুযোগ নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে মেনে চললে ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ সম্ভব। সুতরাং আদর্শবাদী ব্যাখ্যায় আইন ও স্বাধীনতার কোন পার্থক্য করা হয় নি, এটা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার অস্বীকৃতি মাত্র। অধ্যাপক হবহাউস আদর্শবাদের তীব্র সমালোচনা করে মন্তব্য করেছেন যে, আদর্শবাদ স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা অপেক্ষা প্রকৃতপক্ষে আদর্শের চরম বিরোধিতা করেছে।
(৪) রক্ষণশীলতার সমর্থক: আদর্শবাদ আদর্শ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নি, অসম্পূর্ণ সামাজিক অবস্থাকে আদর্শ বলে প্রচার করেছে, অ্যারিস্টটল ক্রীতদাস প্রথাকে সহজ স্বীকৃতি দিয়েছেন। হেগেল যুদ্ধকে গৌরবমণ্ডিত করেছেন এবং গ্রীন ধনতন্ত্রের কোন ত্রুটি স্বীকার করেন নি। সুতরাং এটি রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সমর্থন ছাড়া আর কিছু নয়।
(৫) বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি: আদর্শবাদ রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা এবং যুদ্ধের নৈতিক প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে এক বিপজ্জনক মতবাদের সৃষ্টি করেছে। সভ্যতার ধ্বংসের কারণ যুদ্ধকে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করে আদর্শবাদীগণ মানবতার শত্রু বলে সমালোচিত হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গী সর্বনাশা ফ্যাসীবাদ, নাৎসীবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা করেছে। সুতরাং যুক্তির বিচারে একে গ্রহণ করা যায় না।
(৬) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজ বিকাশের চূড়ান্ত, শ্রেষ্ঠ স্তর হিসাবে রাষ্ট্রকে গ্রহণ করে ভাববাদীগণ ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করেছেন বলে মার্কসবাদীরা মনে করেন। রাষ্ট্র শাশ্বত, চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান নয়; সমাজবিকাশের নির্দিষ্ট অধ্যায়ে শ্রেণী বিভাজনের কারণে রাষ্ট্রের উদ্ভব। শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হল রাষ্ট্র। সুতরাং সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-শোষণের অবসান ঘটলে রাষ্ট্রও ক্রমশঃ বিলুপ্ত হবে। রাষ্ট্রকে সমাজ বিকাশের চরম স্তর বলে গণ্য করলে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির মূল কারণ অস্বীকার করা হবে।
মূল্যায়ন
আদর্শবাদ বা ভাববাদের বিকৃত ব্যাখ্যা আদর্শবাদকে বিপজ্জনক মতবাদে পরিণত করেছে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তত্ত্বের দিক থেকে আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কল্পনার দিক থেকে এর কিছু গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য যে প্রয়োজন তা অস্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া, রাষ্ট্র আইনের উৎস এবং আইন প্রয়োগে শক্তির প্রয়োজন তাও অযৌক্তিক নয়। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের আনুগত্য দাবি করতে পারে—গ্রীণের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। বিকৃত ব্যাখ্যার ফলে আদর্শবাদ প্রতিক্রিয়াশীল রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং সে কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।