শামসুদ্দিন ইলতুৎমিস ছিলেন মধ্য যুগের ভারত ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান। ইলতুৎমিসকে দিল্লির তুর্কি সুলতান বা দাস-বংশীয় সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে ‘আদি তুর্কি সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, ইলতুৎমিস ছিলেন ‘দাস বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা’। ডঃ রামপ্রসাদ ত্রিপাঠীর মতে, ইলতুৎমিশ ছিলেন ‘ভারতে মুসলিম সার্বভৌমত্বের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা’।
প্রথম জীবন
ইলতুৎমিস ছিলেন তুর্কিস্তানের ইলবারি গোষ্ঠীভুক্ত এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তিনি খুবই সুদর্শন ও মধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর ভাইরা ঈর্ষাবশত তাঁকে ‘দাস’ হিসেবে বিক্রি করে দেন। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ চুস্ত কাবা নামে এক দাস-ব্যবসায়ী তাঁকে গজনিতে নিয়ে আসেন। এরপর কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁকে দিল্লিতে ক্রয় করেন। ইলতুৎমিস অতি অল্প বয়সে সাহিত্য, ধনুর্বিদ্যা ও সামরিক শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য ও বিভিন্ন গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে কুতুবউদ্দিন নিজ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন এবং তাঁকে উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তিনি ‘আমির-ই-শিকার’ পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে গোয়ালিয়র, বারান (বুলন্দশহর) ও বদাউন-এর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১২০৫-১২০৬ খ্রিস্টাব্দে খোক্কর উপজাতির বিদ্রোহ দমনে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করলে কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন এবং ‘আমির-উল-ওমরা’ পদে উন্নীত করেন।
সিংহাসন আরোহণ
কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর লাহোরের আমির-ওমরাহরা তাঁর দত্তকপুত্র আরাম শাহকে লাহোরের ‘সুলতান’ হিসেবে মনোনীত করেন। তাঁর অপশাসনে দেশের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে দিল্লির আমিররা কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও বদাউনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিসকে নব-প্রতিষ্ঠিত তুর্কি রাজ্যের শাসনভার গ্রহণের আবেদন জানান। তাঁদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইলতুৎমিস দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন এবং আরাম শাহকে পরাজিত ও বন্দি করে ১২১১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
সমস্যা
সিংহাসনে আরোহণ করে ইলতুৎমিসকে নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
- কুতুবউদ্দিনের সহকর্মী ও সিন্ধুদেশের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা নিজেকে স্বাধীন নরপতি রূপে ঘোষণা করে লাহোর জয় করেন ও পাঞ্জাব দখলের পরিকল্পনা করেন।
- কুতুবউদ্দিনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তাজউদ্দিন ইলদুজ গজনির শাসক হিসেবে ভারতের উপর নিজ সার্বভৌমত্ব দাবি করেন ও ইলতুৎমিসকে নিজ প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করতে চান।
- বাংলার তৎকালীন শাসনকর্তা খলজি আলিমর্দান দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
- বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জালোর, রথথম্বোর, আজমির, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর এবং দোয়াব অঞ্চল প্রভৃতি স্থানের রাজপুতগণ ক্ষমতা পুনর্দখল করেন।
- এছাড়া, দিল্লি সুলতানির কিছু আমির ইলতুৎমিসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
সমাধান
ইলতুৎমিস সংকটময় পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে কঠোর হস্তে শত্রুদমনে অগ্রসর হন।
- প্রথমে তিনি দিল্লি, বদাউন, অযোধ্যা, বারাণসী, শিবালিক প্রভৃতি অঞ্চলের বিদ্রোহী আমির-ওমরাহদের দমন করে নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
- গজনির শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইলদুজ ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের যুদ্ধে ইলতুৎমিসের কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। পরে তিনি বদাউনের কারাগারে নিহত হন।
- উচু ও মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে মানসেরার যুদ্ধে ইলতুৎমিসের হাতে পরাজিত হয়ে সিন্ধু প্রদেশে পালিয়ে যান। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় তিনি ইলতুৎমিসের হাতে পরাজিত হন এবং সিন্ধু নদের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এর ফলে মুলতান ও সিন্ধুর উপর ইলতুৎমিসের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
- বাংলার খলজি আলিমর্দান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে গিয়াসউদ্দিন খলজি তাঁকে হত্যা করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস তাঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে গিয়াসউদ্দিন বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। ইলতুৎমিস দিল্লি ফিরে গেলে তিনি পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সময় ইলতুৎমিসের পুত্র অযোধ্যার শাসক নাসিরউদ্দিন মামুদ ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ আক্রমণ করে গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করেন এবং তিনি বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে বলকা খলজি স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করার চেষ্টা করেন। ইলতুৎমিস তাঁকে হত্যা করে আলাউদ্দিন জানি-কে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। বাংলায় সুলতানি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- এছাড়া তিনি রথথম্বোর (১২২৫ খ্রিঃ), জালোর (১২২৬ খ্রিঃ), যোধপুর (১২২৭ খ্রিঃ), গোয়ালিয়র (১২৩১ খ্রিঃ), গুজরাট (১২৩২ খ্রিঃ) প্রভৃতি স্থানগুলি পুনরুদ্ধার করেন।
রাজ্যজয়
ইলতুৎমিস দিল্লি সুলতানির আধিপত্য সম্প্রসারিত করেন। তিনি শিবালিক পর্বতের অন্তর্গত মান্দোর জয় করেন এবং মালব রাজ্য আক্রমণ করে ভিলসা ও উজ্জয়িনী দখল করেন (১২৩৪ খ্রিঃ)। উজ্জয়িনী জয়ের পর সেখান থেকে সম্রাট বিক্রমাদিত্যের একটি মূর্তি দিল্লি নিয়ে যান।
মোঙ্গল আক্রমণ
ইলতুৎমিসের রাজত্বকালে (১২২১ খ্রিস্টাব্দে) দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খাঁ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার নানা রাজ্য জয় করে খিবা বা খোয়ারিজম রাজ্য আক্রমণ করেন। খিবার অধিপতি জালালউদ্দিন মঙ্গবরণী পালিয়ে পাঞ্জাবে উপস্থিত হয়ে ইলতুৎমিসের আশ্রয় ভিক্ষা করেন। প্রখর কূটনীতির পরিচয় দিয়ে ইলতুৎমিস তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে নবপ্রতিষ্ঠিত সুলতান-শাহি আশু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
খলিফার অনুমোদন
বাগদাদের খলিফা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু ও শ্রেষ্ঠ শাসক বলে বিবেচিত হতেন। ইলতুৎমিস নিজ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে খলিফার কাছে দূত পাঠান। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুন্তানশির বিল্লাহ তাঁকে ‘সুলতান-ই-আজম’ বা প্রধান সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন। এর ফলে দিল্লির সিংহাসনে তাঁর বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, দিল্লি সুলতানির গৌরব বৃদ্ধি পায় এবং দিল্লি সুলতানির স্বাধীন ও পৃথক অস্তিত্ব মুসলিম জগতে স্বীকৃতি লাভ করে। খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত ইলতুৎমিস খলিফার নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলিত করেন এবং তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘খলিফার সেনাপতি’ বলে অভিহিত করেন।
কৃতিত্ব
ইলতুৎমিসকে দিল্লির তুর্কি সুলতান বা দাস বংশীয় সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান বলা হয়। অনেকের মতে, তিনি হলেন দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। কুতুবউদ্দিন রাজ্যজয় করেছিলেন, কিন্তু তা সুসংহত করতে পারেন নি। আরাম শাহের রাজত্বকালে রাজ্যের বহু অংশ দিল্লির হস্তচ্যুত হয়ে যায়। ইলতুৎমিস সেই অংশগুলি পুনরুদ্ধার করে সুলতানি শাসনকে সুসংহত ও দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
ঐতিহাসিক ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী বলেন যে, তাঁর আমল থেকেই ভারতে সার্বভৌম মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তিনি দেশকে দিয়েছিলেন (১) একটি রাজধানী, (২) গজনি ও ঘুরের অধীনতা থেকে মুক্ত এবং খলিফা কর্তৃক স্বীকৃত একটি স্বাধীন রাজ্য, (৩) একটি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং (৪) তুর্কি আমিরদের দ্বারা গঠিত একটি শাসকশ্রেণি।
কুতুবউদ্দিনের সময়ে নবপ্রতিষ্ঠিত তুর্কি রাজ্যের উপর মধ্য এশিয়ার প্রভাব নানাভাবে কাজ করছিল, কিন্তু ইলতুৎমিস মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তুর্কি সুলতানদের মধ্যে ইলতুৎমিস প্রথম ‘ইকতা’ ব্যবস্থা, স্থায়ী সামরিক বাহিনী, মুদ্রার প্রবর্তন ও দরবারে নানা আদব-কায়দার প্রবর্তন করে ভারতে অসামরিক তুর্কি শাসনের সূচনা করেন। তিনি রূপার তৈরি মুদ্রা (‘তঙ্কা’) ও তামা তৈরি মুদ্রা (‘জিতল’) প্রবর্তন করেছিলেন। ভারতের আধুনিক টাকার আদিম পূর্বপুরুষ হল ইলতুৎমিস প্রবর্তিত ‘তঙ্কা’।
কুতুবউদ্দিনের আমলে সাময়িকভাবে দিল্লি রাজধানীর মর্যাদা পেলেও, ইলতুৎমিসের আমল থেকেই তা প্রকৃতপক্ষে ভারতের তুর্কি রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং তিনি দিল্লি নগরীকে মসজিদ, মিনার ও অট্টালিকায় সুসজ্জিত করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি করেন। মধ্য এশিয়ার বিতাড়িত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বিদ্বান ব্যক্তিদের দিল্লিতে আশ্রয় দিয়ে তিনি দিল্লিকে ইসলামীয় সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেন।
ইলতুৎমিস ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, ধার্মিক, বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পানুরাগী ছিলেন। সমকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত মিনহাজ-উস-সিরাজ, হাসান নিজামি, মহম্মদ আউফি, নূরউদ্দিন প্রমুখ তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন। তিনি বিখ্যাত কুতুব মিনারের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেন।