শিক্ষার পরোক্ষ মাধ্যম হিসেবে গৃহ বা পরিবারের কাজ ও ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য গৃহ বা পরিবারের দান সত্যই অপরিসীম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ শিশুশিক্ষায় গৃহের বা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। স্কুল-বহির্ভূত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বলতেও গৃহের কথা উল্লেখ করা যায়। স্কুল-বহির্ভূত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে গৃহ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কৃষ্টিমূলক সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মুদ্রাযন্ত্র, রেডিও, পাঠাগার এবং বিভিন্ন জনশিক্ষামূলক সংস্থাগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিবার বা গৃহের গুরুত্ব
শিক্ষাবিদ রেমন্ট (Raymont) শিশুশিক্ষায় গৃহ বা পরিবারের কাজ ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে শিক্ষা-জীবনের প্রথম ছ’বছর উপযুক্তভাবে কাটতে পারে একমাত্র গৃহ বা পরিবারের মধ্যে এবং এমন ধরনের বিদ্যালয়ে যেখানে গৃহ বা পরিবারের স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ ও প্রীতিপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্কের আবহাওয়া মূর্ত হয়ে উঠতে পারে।
তিনি আরো বলেছেন যে দুটি ভিন্ন গৃহ বা পরিবার থেকে আগত দুটি শিশু একই বিদ্যালয়ে এসে একই স্নেহচ্ছায়ায় শিক্ষালাভ করে এবং একই ধরনের শৃঙ্খলা ও প্রভাবের মধ্যে থেকে একমাত্র পরিবার বা গৃহের পার্থক্য হেতুই ভিন্ন প্রকৃতির আচরণ, উচ্চারণ, জ্ঞান, আগ্রহ ও নীতিবোধ প্রকাশ করতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে গৃহ বা পরিবার ঠিকমত না চললে বিদ্যালয়কে শিশুশিক্ষায় খুবই অসহায়ের ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি-প্রক্ষোভের সুসংহত ও স্বাভাবিক বিকাশের কাজে গৃহ বা পরিবারের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাধীন পরিবেশের দান সত্যই সীমাহীন। প্রতিটি শিশুর সাথে গৃহের সম্পর্ক যেন ছোট পাখির সাথে তার নীড়ের সম্পর্কের মত।
গৃহ বা পরিবারই একমাত্র স্থান যেখানে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, উদারতা প্রভৃতি গুণাবলি শিশুদের মধ্যে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত শিশুদের মধ্যে যা কিছু সত্য, শিব ও সুন্দর এবং তাদের জন্য যা কিছু মধুময়, মঙ্গলময় ও মানবতাধর্মী তাকে মূর্ত করে তোলার কাজে গৃহ বা পরিবারের দায়িত্বশীলতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
পরিবারই হচ্ছে এমন একটি উল্লেখযোগ্য স্থান যেখানে প্রত্যেক শিশু ন্যায়-অন্যায়, নীচতা-উদারতা, স্বার্থপরতা-নিঃস্বার্থপরতা, কপটতা-অকপটতা প্রভৃতির মধ্যে প্রকৃত পার্থক্যটুকু অনুধাবন করতে শেখে। তাই শিশুশিক্ষায় মায়ের প্রভাবের কথা সকল শিক্ষাবিদই একবাক্যে স্বীকার করে থাকেন।
শিক্ষাবিদ জর্জ হার্বার্ট বলতেন যে, একজন সৎ উপযুক্ত মায়ের ভূমিকা একশোর বেশি বিদ্যালয়-শিক্ষকের সমষ্টিগত ভূমিকার সমান মনে করা যেতে পারে (“A good mother is worth a hundred school masters.” — George Herbert)। গৃহের পরিবেশে পিতামাতা ও অন্যান্য সভ্যকে অনুকরণ (imitation) করেই শিশুদের আচরণ কাম্য বা অকাম্য হয়ে উঠতে পারে।
রাসেল শিশুদের সুশিক্ষায় পিতামাতার প্রভাবের কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেই বলতেন যে গৃহে পিতামাতার সুব্যবহারের অকৃত্রিম ছাপ, তাদের স্নেহপ্রবণ মনের প্রকাশ, শিক্ষামূলক উপদেশ এবং বিশেষ করে মাতৃক্রোড়ের মনোভাব গঠনে সত্যই এক অনবদ্য প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে।
বস্তুত গৃহের স্নেহময় পরিবেশ প্রত্যেক শিশুর জীবনে এক সুস্নিগ্ধ আবহাওয়া সৃষ্টি করে তার জীবনে নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তোলে। একমাত্র গৃহ বা পরিবারই প্রত্যেক শিশুর জীবনের প্রাথমিক স্তরের দৈহিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক চাহিদাগুলো যোগ্যতার সঙ্গে মিটিয়ে শিশুর জীবনবিকাশের ধারাকে প্রাণময় ও জীবন্ত করে তুলতে পারে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নেপোলিয়ন ও অন্যান্য বহু মনীষীর জীবনে মায়ের প্রভাব এত বেশি ছিল যে এদের প্রত্যেকের উপযুক্ত শিক্ষায় গৃহ বা পরিবারের ভূমিকা কখনই কম ভাবা যায় না। গৃহের প্রভাব প্রত্যেকের জীবনের প্রথম স্তরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে যে তা জীবনের পরবর্তী স্তরগুলোকেও স্পর্শ না করে পারে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে সুইস শিক্ষাবিদ পেস্তালৎসী ‘How Gertrude Teaches her Children’ বইতে শিশুশিক্ষায় মমতাময়ী মায়ের করুণাময়ী আচরণ-সমৃদ্ধ শিক্ষিকার প্রসঙ্গ টেনে, জার্মানির শিক্ষাবিদ ফ্রয়বেল শিশুশিক্ষায় মায়ের মুখের ছড়াগানের (Mothers’ Songs) প্রভাব উল্লেখ করে এবং ইতালির চিকিৎসক শিক্ষাবিদ মন্তেসরী মাতৃকল্প পরিচালিকার (Directress) শিক্ষার্থীদের মুক্ত স্বাধীনতাকেন্দ্রিক (Free discipline-centred) শিক্ষা পরিচালনার গুরুত্ব অনুধাবন করে মূলত শিক্ষায় মায়েদের এবং গৃহের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
যাহোক, বিধিবদ্ধ শিক্ষার প্রত্যক্ষ মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয় সৃষ্টি হওয়ার আগে গৃহ বা পরিবার শিক্ষার উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করেছে। গৃহ বা পরিবার ব্যক্তির সংগতিসাধনের কাজে এবং ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ বিকাশের কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার চাহিদা, স্বাচ্ছন্দ্যের চাহিদা, সক্রিয়তার চাহিদা, স্বাধীনতার চাহিদা প্রভৃতি বিভিন্ন দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদার সুষ্ঠু পূরণের মাধ্যমে গৃহ বা পরিবার তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য সৃষ্টিতে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
এজন্য শৈশবকালীন গৃহ-পরিবেশের অসুস্থ অবস্থাই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং তাদের জীবনে অপসংগতিমূলক, অপরাধমূলক ও সমস্যামূলক আচরণকে মূর্ত করে তোলে।
ইংরাজিতে যে প্রবাদটুকু আছে— ‘Charity begins at home’ তার সত্যতা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে—বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়। শিশুরা বাড়ির উঠানে বা উদ্যানে ফুলের মত বিরাজ করে এবং এজন্য বলা হয় ‘Children are the beautiful flowers in the garden’, তাই ভগবানের প্রতিকৃতি ও প্রতিনিধি হিসেবে গৃহের পরিবেশ থেকে সকল সুশিক্ষার আচরণ ও অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে শিশুরা।
উপরের ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মনোচিকিৎসক এডলার (Adler) যথার্থ ভেবেছেন যে, একজন শিশু তিন বছর বয়সের পর থেকেই তার আচরণধারায় একটি ছাঁচ বা ধরনকে (pattern) গড়ে তোলে এবং পরবর্তী জীবনে এই ছাঁচটাই তার জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
পরিবারের সভ্যদের সুসম্পর্কের আচরণ শিশুদের জীবনে বিভিন্ন ব্যক্তিকল্যাণমূলক ও সমাজকল্যাণমূলক সুবৃত্তি ও সৎ চিন্তা জাগিয়ে তোলে এবং সুস্থ ও সমৃদ্ধ সামাজিক জীব হিসেবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। ফলত পরিবারের প্রভাবে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত ও বিকশিত শিশুরাই তো গীতি সুধারসে সিক্ত হয়ে গানের সুরে যে কলি দুটি গাইতে পারে তা হচ্ছে—
“Home, Home, Sweet Home
there’s no place like Home”
আধুনিক গৃহ বা পরিবারের মধ্যে শিশুশিক্ষা প্রসারের অন্তরায় সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো আজকাল বিশেষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষাবিদ রাসেল গৃহের পরিবেশে শিশুর বিকাশের অন্তরায়সমূহের যে সকল উপাদান লিপিবদ্ধ করেছেন সেগুলি আজকালের ব্যবধানে, জনসংখ্যার প্লাবনে, গ্রাম-নগরের বিষম উন্নয়নধারায়, শিক্ষাধারাকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার অক্ষমতায় ও বাসহীনতায় সমাজের তৃণমূলস্তরে ব্যয়বহুল সুশিক্ষার ব্যয়বহনের সক্ষমতার অভাবে এবং কাম্য ভূমি-সংস্কারজনিত সুফলসমূহের সুবণ্টনের অভাবে এতই প্রকট যে গৃহ বা পরিবার আজ সঠিকভাবে শিক্ষার প্রত্যক্ষ মাধ্যম হিসেবে কখনই কাজ করতে পারছে না।
আজ পরিবার বা গৃহের শিক্ষার প্রত্যক্ষ মাধ্যম হিসেবে শিশুশিক্ষায় বিশেষ কোন স্থান নেই বললেই চলে। এমন কি এখন শিক্ষার পরোক্ষ মাধ্যম হিসেবেও গৃহ-পরিবেশের পরিমার্জনা বিশেষ প্রয়োজন।