১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের জোটনিরপেক্ষতা নীতি অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়া দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকায় ভারতবর্ষকে কূটনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। কোরিয়া যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল যে, ভারত দুটি বিপরীত শক্তির মধ্যে যতটা সম্ভব ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছিল।
কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ২৫ জুন রেজোলিউশনে আগ্রাসী শক্তিকে চিহ্নিত করে। ভারত রেজোলিউশনে সম্মতি দিয়েছিল। ২৭ জুন আরেকটি রেজোলিউশন পাস করা হয় এবং তাতে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ ও ২৭ জুন গৃহীত রেজোলিউশন গ্রহণ করলেও পরবর্তী পর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলিতে ভারত পশ্চিমি শক্তির প্রতি পুরোপুরিভাবে সমর্থন প্রদান করেনি। আসলে ভারত দুটি বিরোধী গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করতে চায়নি। ভারতের বক্তব্য ছিল যে, চিন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কোন পক্ষকে ভারত পুরোপুরি বিক্ষুব্ধ করার পক্ষপাতী ছিল না।
১৯৫০ সালের ৩০ জুন ভারত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করে। নিরাপত্তা পরিষদে ভারত, চিন, সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে আলাপ-আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষে মত ব্যক্ত করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্তাটি প্রত্যাখ্যান করে। নিরাপত্তা পরিষদে চিনের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া ভারত ৩৮° অক্ষাংশরেখা অতিক্রম না করার জন্য চিনকে অনুরোধ জানায়। ভারত এশিয়া এবং আরবরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। ১৯৫১ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ভারত এই মর্মে একটি বার্তা পাঠায় যে, চিন সম্মেলনে যোগদান করার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে আগ্রাসী হিসেবে সাব্যস্ত করে। শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভারতের ভূমিকা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়। কোরিয়া যুদ্ধে ভারতীয় কূটনীতির হিসেব-নিকেশ নিলে দেখা যায় যে, মোটামুটিভাবে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে কোরিয়া যুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; যখন ভারতকে যুদ্ধবন্দি প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত দায়িত্বভার প্রদান করা হয়। পশ্চিমি দেশগুলি চেয়েছিল যে যুদ্ধবন্দিরা স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। কিন্তু চিন ও রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া বাধ্যতামূলক যুদ্ধবন্দী প্রত্যার্পণের দাবি জানিয়েছিল। ফলে এ ব্যাপারে কোন সমাধান লাভ করা সম্ভবপর হয়নি। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর ভারত একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে যা উভয় তরফে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারত স্বেচ্ছামূলক ও বাধ্যতামূলক যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণের মাঝামাঝি পর্যায়ের পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারিভাবে ভারতের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারিভাবে প্রস্তাব বাতিল করে। যদিও কিছুদিন বাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে ভারতের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সোভিয়েত রাশিয়া এবং চিন অবশ্য অভিযোগ জানায় যে, ভারতের খসড়া প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। ফলে ভারতের মধ্যস্থতার বিষয়টি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে।
১৯৫৩ সালের মার্চে চিন ভারতের প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয় এবং উত্তর কোরিয়া আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালের ৮ জুন অবশেষে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের আগেকার খসড়া প্রস্তাব এবং ১৯৫৩ সালের ৮ জুন প্রস্তাবের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কেননা ৮ জুনের প্রস্তাব ভারত যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত বিষয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে গ্রহণ করে। ভারত ছাড়া চেকোশ্লোভাকিয়া, সুইডেন, পোল্যান্ড ইত্যাদি সদস্য রাষ্ট্র ছিল। তবে ভারতের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি ছিল। ভারতের দায়িত্ব নিঃসন্দেহে জটিল ছিল। ভারতকে সুরক্ষা খাতে ৬ হাজার সৈন্যবাহিনী জোগান দিতে হয়েছিল। কিন্তু এই বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এবং অন্যান্য বেশ কিছু শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। ভারত সংশ্লিষ্ট বন্দিদের মতামত গ্রহণের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল। ফলে এই ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ভারত সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির হাতে যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যার্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই কারণে ভারতকে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
সামগ্রিক বিচারে ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতির ইতিবাচক দিকগুলিকে পরিস্ফুট করে তুলতে উদ্যোগী হয় এবং মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সাফল্যের পরিচয় দেয়। মূলত ভারতের প্রচেষ্টার দরুন জোটনিরপেক্ষ নীতি একটি কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে ভারতের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করে। যদিও কতগুলি ক্ষেত্রে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুণ্ণ করেছিল এই কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। ভারত কোরিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কতগুলি বিষয়ে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব প্রদান করার দরুন সমস্যা দেখা দেয়। ভারত আভ্যন্তরীণ বিষয়ের ওপর সেই অনুপাতে গুরুত্ব দিলে তা ভারতের দিক থেকে বাঞ্ছনীয় হত।