বর্তমান বৃহদায়তন ও কর্মমুখর রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রকার স্বার্থসম্পন্ন গোষ্ঠী বিদ্যমান রয়েছে। এদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা স্বার্থগোষ্ঠী (Interest Groups), চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Pressure Groups), সমদৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন গোষ্ঠী (Attitude Groups), রাজনৈতিক গোষ্ঠী (Political Groups), লবী (Lobby), সংগঠিত গোষ্ঠী (Organised Groups) প্রভূতি নামে অভিহিত করে থাকেন। এঁরা কোন-না-কোন ভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত রয়েছে। এঁরা বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ বা সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করাই এইসব গোষ্ঠীর মুখ্য উদ্দেশ্য।
স্বার্থগোষ্ঠীর সংজ্ঞা (Definition)
ডেভিড ট্রুম্যানের মতে, সমদৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তির সমষ্টিকে স্বার্থগোষ্ঠী বলা যেতে পারে, যারা সমদৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজ কার্যপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে থাকে। সমদৃষ্টিভঙ্গীই স্বার্থের সৃষ্টি করে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল স্বার্থগোষ্ঠীর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন, কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ বা সুযোগ-সুবিধার দ্বারা সংযুক্ত এবং এই বন্ধন সম্পর্কে সচেতন জনসমষ্টিকেই স্বার্থগোষ্ঠী বলা যেতে পারে। এল. আর্লশ ও জন সি. পিয়ার্স বলেন, স্বর্থোন্বেষী গোষ্ঠী হোল এমন একটি ব্যক্তিসমষ্টি বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর দাবি উপস্থিত করে তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। জিগলার বলেন, স্বার্থগোষ্ঠী হল এরূপ এক ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি যা নিজস্ব সদস্যগণকে সরকারী পদে অধিষ্ঠিত না করেও সরকারী সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। শ্রমিক সংঘ, বণিক সভা, শিক্ষক সংঘ, কৃষক সমিতি প্রভৃতি স্বার্থগোষ্ঠীর উদাহরণ।
স্বার্থগোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাগ (Types)
অ্যালমন্ড এবং পাওয়েল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, যথা—(১) স্বতঃস্ফূর্ত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Spontaneous interest group), (২) সংগঠনবিহীন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Non-associate interest group), (৩) সংগঠনভিত্তিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Associated interest group) এবং (৪) প্রতিষ্ঠানগত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Institutional Group)।
(১) স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থগোষ্ঠী কোন ঘটনা বা অভিযোগ অসন্তোষকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিক্ষোভ, গুপ্তহত্যা প্রভৃতির দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে হিংসাত্মক গোষ্ঠী লক্ষ্য করা যায়।
(২) সংগঠনহীন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বলতে বিভিন্ন শ্রেণীভিত্তিক গোষ্ঠী (class), জাতিভিত্তিক (ethnic) এবং ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী (Language group) বোঝায়। এই স্বার্থগোষ্ঠী বিশেষভাবে সংগঠিত নয়, কোন ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় প্রতিনিধির মাধ্যমে এরা নিজ স্বার্থের অভিপ্রকাশ করতে চেষ্টা করে।
(৩) সংগঠনভিত্তিক স্বার্থগোষ্ঠী নিজ নিজ দাবি-দাওয়া পেশ বা স্বার্থের অভিপ্রকাশের জন্য বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী বলা হয়। শ্রমিকসংঘ, বণিক সংঘ, শিল্পপতি সংঘ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক সংঘ প্রভৃতি এর উদাহরণ। এই সকল স্বার্থগোষ্ঠীর নিজস্ব পেশাদার কর্মী থাকে এবং সুসংহতভাবে তারা নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে যথাযথভাবে দাবি-দাওয়া পেশ করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তারে এই গোষ্ঠীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
(৪) প্রতিষ্ঠানগত স্বার্থগোষ্ঠী কোন পেশা বা বৃত্তিভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়। আইনসভা, সেনাবাহিনী, এমন কি রাজনৈতিক দলের মধ্যেও এরূপ গোষ্ঠীর সন্ধান মেলে। এই সকল গোষ্ঠী নিজ সদস্যদের বা অন্য কোন গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সামরিক চক্র (military clique), আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দলের মধ্যে উপদল বা কুচক্রী দল (clique or coterie) বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে।
স্বার্থগোষ্ঠী কার্যের বিভিন্ন মাধ্যম (Channels)
স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য হল শাসন কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগ্রহী করা হয়। একবিংশ শতাব্দীতে আইনসভা অপেক্ষা শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বার্থগোষ্ঠীগুলি স্বাভাবিকভাবে শাসন বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়।
(১) ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব বিস্তারঃ অনেক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় যোগাযোগ, আত্মীয়তা, বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূত্রে স্বার্থগোষ্ঠী নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধ করতে পারে। পদস্থ আমলা বা উচ্চস্তরের শাসন-কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই ধরনের কার্যাবলী করবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
(২) সরকারী সংস্থায় প্রতিনিধি প্রেরণ: সরকারী বিভিন্ন সংস্থায় প্রতিনিধি প্রেরণ করে স্বার্থগোষ্ঠী নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে। ব্রিটেনে বিভিন্ন স্থায়ী উপদেষ্টা কমিটিতে স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রয়েছে, যথা—শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সরবরাহ সম্পর্কিত জাতীয় উপদেষ্টা সংস্থা। ফ্রান্সে বাণিজ্য ও শিল্প সংস্থার মতো বিভিন্ন সংস্থার স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের সুযোগ রয়েছে। এই সংস্থাগুলির মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সরকারকে সচেতন এবং সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
(৩) প্রচার-মাধ্যম দ্বারা আন্দোলন সংগঠন: সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচারকার্যের দ্বারা স্বার্থগোষ্ঠীগুলি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচার-মাধ্যমের দ্বারা জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন সংঘটিত করতে সংগঠিত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সক্ষম হয়।
(৪) রাজনৈতিক দলের মাধ্যম উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা: রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে কোন স্বার্থগোষ্ঠীর অনুকূলে কাজ করে না। কিন্তু স্বার্থগোষ্ঠীগুলি পরোক্ষভাবে বিভিন্ন শাখাসংগঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের নীতি ও কর্মসূচীর ওপর প্রভাব বিস্তারে এবং উদ্দেশ্য সাধনে সচেষ্ট হয়। ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলের সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠী আপন স্বার্থ সাধনের চেষ্টা করে। ভারতে বিজেপি দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় নানা স্বার্থগোষ্ঠী কংগ্রেস দলের মাধ্যমেই আপন আপন স্বার্থ সাধন করতে সমর্থ হয়েছে।
(৫) আইনসভার সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার: বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনসভাগুলির মাধ্যমেই স্বার্থগোষ্ঠীগুলি তাদের স্বার্থ পূরণের জন্য অধিক সক্রিয় হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে স্বার্থগোষ্ঠীর লবি আইনসভায় স্বার্থগোষ্ঠীর অনুকূল আইন প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাছাড়া সহানুভূতিসম্পন্ন প্রার্থীদের নির্বাচনে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেও আইনসভার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপীয় আইনসভা-সদস্যদের অনেকের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যয় স্বার্থগোষ্ঠী বহন করে। অনেক সময় প্রতিনিধিগণ ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী ও শিক্ষা-দীক্ষার কারণে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন থাকেন।
(৬) শাসন বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা: বর্তমান কালে বিভিন্ন দেশে আইনসভা অপেক্ষা শাসন বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠী কার্য সাধন করে থাকে। ভারত, ব্রিটেন প্রভৃতি প্রত্যক্ষভাবে মন্ত্রিগণের এবং আমলাগণের মাধ্যমে কাজ সিদ্ধি করবার জন্য স্বার্থগোষ্ঠীকে উৎসাহী হতে দেখা যায়। অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলিই এই বিষয়ে অধিক তৎপর হয়। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বলিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করা স্বার্থগোষ্ঠীর অন্যতম লক্ষ্য। সরকারী দপ্তরগুলি নানাভাবে স্বার্থগোষ্ঠীর নিকট তথ্য সংগ্রহ করতে চায় এবং সহযোগিতা আশা করে। স্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠীর মতামত সরকারের নীতি ও আইনের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বণিকগোষ্ঠীগুলি অধিক প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে।
(৭) আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বার্থগোষ্ঠীগুলি আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে গোষ্ঠীস্বার্থ সাধন করতে সচেষ্ট হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদালতগুলি আইনসভা বা শাসনবিভাগের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারে। তা ছাড়া আইনকে ব্যাখ্যা করবার ক্ষমতাও তারা ভোগ করে। সুতরাং স্বার্থগোষ্ঠীগুলি বিচারালয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। স্বার্থগোষ্ঠী বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগে সচেষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, তারা পরীক্ষামূলকভাবে মামলা দায়ের করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে নজীর (Precedence) উল্লেখপূর্বক বিচারকগণকে প্রভাবান্বিত করবার চেষ্টা করে।
স্বার্থগোষ্ঠীর কার্য-নির্ধারক বিষয় (Influence Factors)
অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বার্থগোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কার্যপদ্ধতি নির্ভর করে তিনটি প্রধান বিষয়ের উপর—(১) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো (Political institutional structure), (২) দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি (nature of the party system) এবং (৩) রাজনৈতিক সংস্কৃতি (political culture) প্রভূতির উপর স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কার্যের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে।
(১) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো অনুযায়ী চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারী সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স বা ভারত প্রভৃতি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত থাকায় মন্ত্রিপরিষদ ও আমলাতন্ত্র অর্থাৎ শাসন বিভাগই অধিক ক্ষমতাশালী হয়। এইক্ষেত্রে স্বার্থগোষ্ঠী শাসন বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির জন্য শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ সমান দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন কংগ্রেসের দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় এবং আইন প্রণয়নে কমিটির ভূমিকা মুখ্য হবার ফলে স্বার্থগোষ্ঠীগুলি কমিটির মাধ্যমে সরকারী সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়।
(২) দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি: দলীয় ব্যবস্থায় কাঠামো, প্রকৃতি ও দলীয় মতাদর্শের দ্বারাও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নির্ধারিত হয়। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দলীয় সংগঠনের দুর্বলতা, দলীয় শৃঙ্খলার অভাব এবং মতাদর্শগত পার্থক্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়, সেখানে স্বার্থগোষ্ঠী সহজেই দলীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দলগুলির উপরি-উক্ত দুর্বলতা স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বলে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটেনেও স্বার্থগোষ্ঠীগুলি দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় তা বলতে পারা যায় না। অবশ্য চতুর্থ সাধারণতান্ত্রিক ফ্রান্সের মতো বহুদলীয় ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের অবাধ ও ব্যাপক সুযোগ ঘটে বলতে পারা যায়।
(৩) রাজনৈতিক সংস্কৃতি: সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপরও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের তারতম্য নির্ভর করে। রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, প্রবণতা প্রভৃতির সমষ্টিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের স্বার্থগোষ্ঠীর কার্যাবলীর প্রতি অধিকতর সহনশীলতা লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপীয় উদারনৈতিক গণতন্ত্রগুলিতে জনগণ স্বার্থগোষ্ঠীকে বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখে। ১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সের ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপক হিংসাত্মক পদ্ধতি গ্রহণ করে সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলিও দাবি আদায়ের জন্য অনেক সময় প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর এই সকল স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে।
রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য
রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা সহজসাধ্য না হলেও উভয়ের মধ্যে কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান বলে অ্যালান বল, নিউম্যান প্রমুখ অভিমত পোষণ করেন।
(১) উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য হল নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করা, প্রার্থীর নির্বাচনী সাফল্যে সক্রিয় হওয়া এবং নির্বাচনের পরবর্তী অধ্যায়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচীকে রূপায়িত করা। অপরদিকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য সরকার গঠন বা সরকার পরিচালনা নয়, গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য বা কর্মসূচীকে সরকারী নীতি ও কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা।
(২) লক্ষ্যগত পার্থক্য: রাজনৈতিক দল কোন সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না। বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্বার্থের সমন্বয় সাধন করে দলের নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে ব্যাপক জনগণের কল্যাণসাধনে সচেষ্ট হয়। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হল বিভিন্ন স্বার্থের অভিপ্রকাশ করা, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ-সম্পর্কিত বিষয়গুলি সরকারী কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করবার জন্য সচেষ্ট হয়।
(৩) প্রকৃতিগত পার্থক্য: রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকতে পারে। দলীয় নীতিকে প্রভাবিত করবার জন্য এই সকল গোষ্ঠী সক্রিয় হয়। অনেক ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্র আকার লাভ করে দলের সংহতি বিনষ্ট করে। স্বার্থগোষ্ঠীগুলি সংকীর্ণ হলেও সমস্বার্থসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত হয়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বিরোধের সম্ভাবনা কম থাকে।
(৪) রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে পার্থক্য: রাজনৈতিক দল উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সর্বাত্মক রাষ্ট্র বা সমাজতন্ত্র—সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ বলে গণ্য হয়। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচনা করা যায় না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণীস্বার্থের দ্বন্দ্ব না থাকায় স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাবও পরিলক্ষিত হয় না।
(৫) সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পার্থক্য: রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় প্রতিটি দলকে জনমতের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় এবং দলীয় আদর্শ, সংহতি ও দলের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য সংরক্ষণ ইত্যাদির দিকে নজর রেখেই রাজনৈতিক দলকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যরা যেহেতু সম-স্বার্থের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ, সেহেতু যে-কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অনেক সহজ। গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা সীমিত হওয়ায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব।
উপসংহার (Conclusion)
উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যে ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ ও কার্যাবলী অনুসরণ করতে সমর্থ হয় স্বৈরতান্ত্রিক বা সর্বাত্মক রাষ্ট্রে তা সম্ভব হয় না। এই সকল রাষ্ট্রে প্রচলিত মতাদর্শের প্রতি এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অস্তিত্বই বিনষ্ট হতে পারে। সকল অবস্থা বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।
স্বার্থগোষ্ঠীর FAQs
Q1. স্বার্থগোষ্ঠী কীভাবে সরকারি নীতি প্রণয়নকে প্রভাবিত করে?
স্বার্থগোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ শাসক গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে সরকারী সিদ্ধান্তকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে আনা। নানাভাবে এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হয়।
(১) ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে সরকারী মহলের ওপর প্রভাব বিস্তার,
(২) সরকারী সংস্থায় প্রতিনিধি পাঠান,
(৩) জনমত গঠন,
(৪) রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে স্বার্থসাধন,
(৫) আইনসভার সদস্যদের প্রভাবান্বিত করা,
(৬) শাসনবিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার, এবং
(৭) কোন কোন দেশে আদালতকে প্রভাবান্বিত করে স্বার্থগোষ্ঠী আপন উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করে।
Q2. স্বার্থগোষ্ঠী কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বেশি সফল হয়?
পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বার্থগোষ্ঠীগুলি অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর বিলোপ কমিউনিস্ট পার্টির দৃঢ় শৃঙ্খলা প্রভৃতির জন্য স্বার্থগোষ্ঠীর ভূমিকা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
Q3. স্বার্থগোষ্ঠী অন্যান্য কী নামে পরিচিত হয়?
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, সমদৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন গোষ্ঠী, রাজনৈতিক গোষ্ঠী, লবী প্রভূতি নামে স্বার্থগোষ্ঠী অভিহিত হয়।