শেরশাহ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের কাজে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সাসারামে পিতার জায়গিরের পরিচালক হিসেবে ভূমি রাজস্ব প্রশাসন কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থার সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি ভারতের শাসক হিসেবে সেই অভিজ্ঞতাকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।
শেরশাহ তিনটি মূল লক্ষ্য সামনে রেখে ভূমি রাজস্ব কর্মসূচী গড়ে তোলেন, যেমন — (১) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা, (২) কৃষকদের অবস্থা সচ্ছল করা এবং (৩) ভূমি রাজস্ব খাতে সরকারি আয় বৃদ্ধি করা। এজন্য তিনি প্রথমে আবাদযোগ্য সমস্ত জমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেন। আমিন, কানুনগো, পাটোয়ারী, মুকদ্দম প্রমুখ রাজস্ব কর্মচারীদের উপর আবাদী জমির সঠিক মাপ ও ভূখণ্ডের উপর কৃষকদের সঠিক অধিকার নির্ধারণের দায়িত্ব দেন। এই কাজে তিনি সিকন্দর লোদী কর্তৃক ব্যবহৃত মাপ অনুসরণ করেন। ‘সিকন্দরী গজ’ (যা আধুনিক এক মিটার দৈর্ঘ্যের তিন-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৩৯ ইঞ্চি) জমির আয়তন পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত হয়। অতঃপর জমিগুলিকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে উৎকৃষ্ট, মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রতি বিঘা জমির (৬০×৬০ বর্গগজ) বার্ষিক উৎপাদনের গড় হিসেব করে জমির বার্ষিক মোট উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এই গড় উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ তিনি রাজস্ব হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দেবার নির্দেশ দেন। উৎপাদিত শস্য কিংবা নগদ অর্থে ভূমি রাজস্ব মেটানো যেত। নগদে রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিভিন্ন শস্যের মূল্যতালিকা কৃষকদের অনুসরণ করতে হত।
শেরশাহ ‘পাট্টা’ ও ‘কবুলিয়ত’ প্রচলন করেন। সরকার জমি জরিপের ভিত্তিতে কৃষকের অধীন জমির পরিমাণ, দাগ নম্বর, রায়তের নাম ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে এবং নির্দিষ্ট জমিতে কৃষকের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে চাষীকে একটি ‘পাট্টা’ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। পরিবর্তে কৃষক উক্ত জমিতে চাষাবাদ করা এবং সরকারকে ধার্য রাজস্ব প্রদান করার দায় কবুল করে একটি অঙ্গীকার পত্র বা ‘কবুলিয়ত’ জমা দিতে বাধ্য থাকে। ভূমি রাজস্ব ছাড়াও কৃষকদের দু’একটি অতিরিক্ত ‘সেস’ দিতে বলা হয়। যেমন—’জরিবানা’ বা জমি পরিমাপকের মজুরী, ‘মুহসিলানা’ বা রাজস্ব আদায়কারীর পারিশ্রমিক ইত্যাদি। সাধারণভাবে রাজস্বের ২.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হারে ‘সেস’ ধার্য করা হত।
শেরশাহের ভূমি রাজস্ব সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মধ্যসত্বভোগী শ্রেণীর বিলোপ। শেরশাহ ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে জমিদার, ইজারাদার প্রমুখকে বাতিল করেন এবং সরকারি কর্মচারী দ্বারা সরাসরি উৎপাদকের (কৃষক) কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। এই কারণে শেরশাহকে ‘ভারতে রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত’ ব্যবস্থার পথিকৃৎ বলা যায়। তিনি অবশ্য গোটা রাজ্যে রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন নি।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা ভ্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে তিনি কৃষকদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। নির্ধারিত হারের অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর শান্তিদানের ব্যবস্থা ছিল। তিনি আমিন, কানুনগো প্রমুখকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের যথেষ্ট যুক্তিবাদী, উদার হওয়া আবশ্যক। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের সময় কোনরকম শিথিলতা সহ্য করা হবে না। অবশ্য অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, যুদ্ধকালে সেনাবাহিনীর যাতায়াত ইত্যাদি কারণে উৎপাদন ব্যহত হলে শেরশাহ খাজনা মুকুব করতেন এবং যথাযথভাবে কৃষিকার্য সম্পন্ন করার জন্য কৃষকদের ‘তাকাভি‘ ঋণ দানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজস্ব আদায়ের মূল দায়িত্ব পরগণাভিত্তিক ভাবে সিকদারের হাতে ন্যস্ত ছিল। এই কাজে তাকে সাহায্য করত করণিকগণ। আইনানুযায়ী ভূমি রাজস্ব বিভাগের প্রশাসনিক খরচা রায়তদের বহন করতে হত। এজন্য তাদের জরিপ খরচা (জরিমানা) এবং রাজস্ব আদায়কারীর খরচা (মহাশিলওয়ালা) বাবদ উৎপন্ন ফসলের ৫ ভাগ আদায় দিতে হত।