রাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে বুর্জোয়া লেখকগণ সম্পূর্ণ ও যথার্থ বলে কখনও মনে করেন নি। ‘রাষ্ট্র নিপীড়নের যন্ত্র’, ‘রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার যন্ত্র’, একটি পর্যায়ে ‘রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে’ — এই সব মার্কসীয় ধারণা সম্পর্কে অনেকেই একমত নন। সমাজ বিকাশের এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক বিশেষ অধ্যায়ে মার্কসবাদের উদ্ভব। মার্কস এবং এঙ্গেলস সমাজবিকাশের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রথম বিশ্লেষণ করেন। তাঁর প্রধান বক্তব্য ছিল দার্শনিকরা দীর্ঘকাল পৃথিবীকে নানা দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মূল কথা হল এর পরিবর্তন করা। মার্কসবাদ তাই কেবল তত্ত্বই নয়, বাস্তব কর্মের পথনির্দেশক। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচকগণ মার্কসবাদের মূল তত্ত্বগুলি অসম্পূর্ণ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।
র্যালফ মিলিব্যান্ড (Ralph Miliband) মার্কসীয় আলোচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যার দিকে দৃষ্টি নাকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে, ‘মার্কসবাদ’ শব্দটির মধ্যেই অস্পষ্টতা আছে। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস মার্কসের সুত্রগুলিকে প্রসারিত করেন। এঙ্গেলসের পর লেনিনসহ বহু মার্কসবাদী মার্কসবাদের মূল ধারণাকে প্রায়োগিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসবাদী লেখকগণ মার্কসের মূল বক্তব্যকে নানা ব্যাখ্যায় অস্পষ্ট করে তুলেছেন। মোলব্যান্ডের মতে, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির অপর একটি সমস্যা হল মার্কস এবং পরিবর্তনকালের মার্কসবাদীদের রচনাবলীর প্রকৃতি নিয়ে। এক নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা ও পরিস্থিতিতে ঐগুলি রচিত। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, রোজা লাকসেমবুর্গ, ট্রটস্কী, গ্রামসীর রচনায় যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে তা অসংবদ্ধ বিচ্ছিন্ন এবং বহুক্ষেত্রে অন্য কোন বিষয়ে বক্তব্যের অংশ। গ্রামসী ছাড়া পরবর্তীকালে অন্য কোন মার্কসবাদী রাজনৈতিক বিষয়ে সুসংবদ্ধ আলোচনা করেন নি। এর ফলে মার্কসবাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যার প্রবণতা জন্ম লাভ করেছে। উদারনৈতিক দর্শনের সমর্থকগণ কার্ল ভাপার, হায়েক, কীনস্, বার্নস্টাইন প্রমুখ লেখকগণ নানাদিক থেকে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করেছেন।
প্রথমত, মার্কসের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হল, মার্কস অর্থনৈতিক উপাদানের ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু সমাজে অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমন, ধ্যান-ধারণা, নীতি, ধর্ম, কৃষ্টি ও সাহিত্যের প্রভাব উপেক্ষার নয়।
দ্বিতীয়ত, মার্কস শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসংগ্রামের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসে শ্রেণীসংগ্রামের কাহিনী যেমন পাওয়া যায়, শ্রেণী সহযোগিতার দৃষ্টান্তও মেলে। সমাজ সুস্পষ্টভাবে বুর্জোয়া ও সর্বহারা এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত নয়, আরও অনেক শ্রেণী, উপ-শ্রেণী আছে।
তৃতীয়ত, বিপ্লবের পথে সমাজ পরিবর্তনের অপরিহার্যতার কথা বলে মার্কসবাদ সমাজে হিংসা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব, সংঘাতকেই বড় করে দেখে। ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা, সহমর্মিতার সঙ্গে মানবগুণাবলীকে অস্বীকার করে।
চতুর্থত, মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণীও সফল হয় নি। শিল্পোন্নত দেশ জার্মানী বা ইংল্যান্ডে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে-একথা তিনি বলেছিলেন। কার্যতঃ দেখা যায় রাশিয়ার মতো অপেক্ষাকৃত কৃষি প্রধান এবং অনগ্রসর দেশে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে।
পঞ্চমত, শ্রেণীহীন সমাজে রাষ্ট্র অবলুপ্ত হয়ে যাবে মার্কসের এই ধারণাকে অনেকে আকাশকুসুম কল্পনা বলে মনে করেন। বিপ্লবের পরে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া রাষ্ট্র শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সমাজকল্যাণকর হতে পারে মার্কস এ কথা বলেন নি। বর্তমান বিশ্বে, অনেক রাষ্ট্রই ‘জনকল্যাণ রাষ্ট্র’ (Welfare State) হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। মার্কসবাদ ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের শত্রু বলে অনেকে মনে করেন।
সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব উপেক্ষার নয়। মার্কসবাদ মানবজাতির শোষণমুক্তির পথপ্রদর্শক এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দর্শন হিসাবে আজ দৃষ্টিভঙ্গি বহুদেশে কোটি কোটি মানুষের অন্তর স্পর্শ করেছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলা যায়।