পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা দুটি ভাগে বিভক্ত; যথা— গ্রাম এলাকায় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা (PRIs) এবং শহর এলাকায় পৌর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা (ULBs)।
1. গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ত্রিস্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রয়েছে; যথা—গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ।
(ক) গ্রাম পঞ্চায়েত
গ্রাম পঞ্চায়েতের গঠন: সাধারণত কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়। গ্রামবাসীদের সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত (সংশোধনী) আইন অনুসারে, বর্তমানে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওইসব সংরক্ষিত আসনের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসনসংখ্যার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ (তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ) মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর।
গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রধানের ওপর ন্যস্ত। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপপ্রধান পঞ্চায়েত প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের আয়ের উৎস হল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অনুদান, সাহায্য ও ঋণ, জমি ও বাড়ির কর, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতির অনুদান ও সাহায্য ইত্যাদি।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ও কার্যাবলি: গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যাবলি প্রধানত তিন প্রকার; যথা— (i) বাধ্যতামূলক কাজ, (ii) অর্পিত কাজ এবং (iii) স্বেচ্ছাধীন কাজ। বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে পানীয় জল সরবরাহ, পথঘাট তৈরি ও সংস্কার, মহামারি প্রতিরোধ ইত্যাদি। অর্পিত কাজের মধ্যে আছে সেচ, ভূমিসংস্কার, কুটিরশিল্প, প্রাথমিক, সামাজিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রভৃতি। এ ছাড়া স্বেচ্ছাধীন কাজের মধ্যে রয়েছে হাটবাজার স্থাপন, নলকূপ খনন ও মেরামতি, রাস্তাঘাট আলোকিতকরণ ইত্যাদি। উল্লিখিত বিষয়গুলি ছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে পারে। এ ছাড়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে ন্যায় পঞ্চায়েত গঠন করার কথাও বলা হয়েছে।
(খ) পঞ্চায়েত সমিতি
পঞ্চায়েত সমিতির গঠন: ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী স্তরে প্রতি ব্লকে একটি করে পঞ্চায়েত সমিতি রয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতি যেসব সদস্য নিয়ে গঠিত হয় তাঁরা হলেন: (i) সংশ্লিষ্ট ব্লকের প্রতিটি গ্রাম থেকে নির্বাচিত অনধিক ৩ জন সদস্য, (ii) সংশ্লিষ্ট ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির প্রধান বা (পদাধিকারবলে), (iii) ব্লক এলাকার বিধানসভা ও লোকসভার নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, (iv) ব্লক এলাকায় বসবাসকারী রাজ্যসভার সদস্য এবং (v) ব্লক এলাকার নির্বাচিত জেলা পরিষদের সদস্যবৃন্দ (সভাধিপতি ও সহসভাধিপতি বাদে)। অবশ্য কোনো মন্ত্রীর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য হতে পারেন না। গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে যে পদ্ধতিতে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য নির্বাচনেও আসন সংরক্ষণে অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। সমিতির কার্যনির্বাহক হিসেবে কাজ করেন ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক (বিডিও)। পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি ও একজনকে সহকারী সভাপতি নির্বাচন করেন। সভাপতি পদাধিকারবলে পঞ্চায়েত সমিতির প্রশাসনিক কর্তা, তাঁর নেতৃত্বে পঞ্চায়েত সমিতির সমস্ত কাজকর্ম পরিচালিত হয়।
পঞ্চায়েত সমিতির অধীনে কতকগুলি স্থায়ী সমিতি কাজ করে। এছাড়া প্রতিটি পঞ্চায়েত সমিতিতে একটি করে ব্লক সংসদ গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতির আয়ের প্রধান উৎস হল রাজ্য সরকারের দেওয়া ভূমি রাজস্বের অন্তা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ, জেলা পরিষদ বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া অর্থ সাহায্য ও অনুদান ইত্যাদি।
পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি: প্রতিটি ব্লক এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েতের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করা পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান কাজ।
(গ) জেলা পরিষদ
জেলা পরিষদের গঠন: পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার তৃতীয় ও শীর্ষস্তরে রয়েছে জেলা পরিষদ। পদাধিকার বলে জেলার পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরা জেলা পরিষদেরও সদস্য। জেলা থেকে নির্বাচিত লোকসভা ও বিধানসভার সদস্যরা এবং জেলায় বসবাসকারী রাজ্যসভার সদস্যরাও জেলাপরিষদের সদস্য হন। এ ছাড়া জেলার প্রতিটি ব্লক থেকে অনধিক তিন জন করে সদস্য সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে জেলা পরিষদে নির্বাচিত হন। প্রসঙ্গত বলা যায়, কোনো মন্ত্রী জেলা পরিষদের সদস্য হতে পারেন না। গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে যে পদ্ধতিতে তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়, অনুরুপ পদ্ধতিতে জেলা পরিষদেও আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা পরিষদের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা তাঁদের প্রথম সভায় নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাধিপতি এবং অন্য একজনকে সহকারী সভাধিপতি নির্বাচন করেন। সভাধিপতি হলেন জেলা পরিষদে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি জেলা পরিষদের প্রশাসনিক প্রধান। জেলা পরিষদের কার্যনির্বাহক রাজ্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। জেলাশাসক এই পদে নিযুক্ত থাকেন।
জেলা পরিষদের অধীনেও কতকগুলি স্থায়ী সমিতি রয়েছে। এ ছাড়া জেলা পরিষদের অধীনে একটি জেলা সংসদ গঠনের সংস্থান রাখা হয়েছে। জেলা পরিষদের আয়ের প্রধান উৎস হল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দেওয়া ঋণ ও অনুদান, পথকর ও পূর্তকর থেকে প্রাপ্ত অর্থ, জরিমানা বা অর্থদণ্ড থেকে আদায়ীকৃত অর্থ ইত্যাদি।
জেলা পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি: জেলা পরিষদের প্রধান কাজ হল পঞ্চায়েত সমিতিগুলির রচিত প্রকল্পসমূহের সমন্বয়সাধন, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, বয়স্কশিক্ষা, জল সরবরাহ প্রভৃতি বিষয়ক পরিকল্পনার যথাযথ রূপায়ণ, জেলার উন্নয়নে রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া, রাজ্য সরকার জেলার উন্নয়নের জন্য অন্য যে-কোনো কাজের দায়িত্ব জেলা পরিষদকে দিতে পারে।
2. পৌর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা
পৌরসভার গঠন: নতুন পৌর আইনে পৌর অঞ্চলগুলিকে কতকগুলি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। নতুন আইনে পৌরসভার সদস্যরা কাউন্সিলার নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পৌর অঞ্চলের সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কাউন্সিলাররা নির্বাচিত হন। গ্রাম পঞ্চায়েতের মতো অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করে পৌরসভাতেও তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পৌর আইনে (১৯৯৪) পৌরসভার কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তিনটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে: (i) পৌর পরিষদ, (ii) সপরিষদ চেয়ারম্যান এবং (iii) চেয়ারম্যান। পৌর পরিষদ সমস্ত নির্বাচিত কাউন্সিলারদের নিয়ে গঠিত হয়। অন্যদিকে সপরিষদ চেয়ারম্যান পৌরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলারদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত হয়। পৌরসভার প্রধান হলেন চেয়ারম্যান। সমগ্র পৌরপ্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে। পৌর পরিষদ এবং সপরিষদ চেয়ারম্যানের সভায় সভাপতিত্ব করেন চেয়ারম্যান। এই তিনটি কর্তৃপক্ষ ছাড়া বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইন (সংশোধনী), ২০০২ অনুসারে ছয় ধরনের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে; যথা— (i) ওয়ার্ড কমিটি, (ii) বরো কমিটি, (iii) যৌথ কমিটি, (iv) স্থায়ী কমিটি, (v) ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কমিটি এবং (৩) বিশেষ কমিটি।
পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি: পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়; যথা—(i) বাধ্যতামূলক, (ii) স্বেচ্ছাধীন এবং (iii) অর্পিত কার্যাবলি। বাধ্যতামূলক কার্যাবলির মধ্যে চারটি প্রধান কাজ স্থান পেয়েছে; যথা—(ক) প্রশাসনিক, (খ) উন্নয়নমূলক, (গ) জনকল্যাণমূলক ও (ঘ) জনস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কাজ। স্বেচ্ছাধীন কাজগুলির মধ্যে ৪১টি বিষয় স্থান পেয়েছে; যেমন—পানীয় জল সরবরাহ, হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশসাধন প্রভৃতি। অন্যদিকে অর্পিত কার্যাবলির তালিকায় উল্লিখিত ১৭টি বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নগর পরিকল্পনা, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ, বনসৃজন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ ইত্যাদি।