মৈত্রক রাজবংশ পশ্চিম ভারতে (বর্তমানে গুজরাট) আনুমানিক 475 থেকে আনুমানিক 776 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিল। মৈত্রক রাজবংশের রাজধানী ছিল বলভী। মৈত্রক বংশের রাজারা শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের উৎপত্তি অনিশ্চিত কিন্তু তাঁরা চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, মৈত্রক বংশীয় রাজন্যবর্গ গুপ্ত বা হুনদের অধীনস্থ ছিলেন। গুপ্ত বা হুনদের পতনের পর তাঁরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
মৈত্রক রাজবংশ
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শেষদিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের দিনে গুপ্তদের সেনাপতি ভট্টারক সৌরাষ্টের বলভীতে ‘মৈত্রক রাজবংশ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভট্টারক ও তাঁর পুত্র প্রথম ধরসেন ‘সেনাপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন। প্রথম ধরসেনের পরবর্তী পাঁচজন রাজা দ্রোনসিংহ, প্রথম ধ্রুবসেন, ধরপত্ত, গুহসেন ও দ্বিতীয় ধরসেন ‘মহারাজা উপাধি গ্রহণ করেন। প্রথম ধ্রুবসেনের আমলে রাজধানী বলভীতে ‘প্রথম জৈন পরিষদ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা তাঁর স্ত্রী চন্দ্রলেখা আয়োজন করেছিল। রাজা ধরপত্ত ছিলেন সূর্যের উপাসক।
দ্বিতীয় ধরসেনের পুত্র প্রথম শিলাদিত্য ছিলেন মৈত্রক বংশের প্রথম স্বাধীন নরপতি। তাঁর রাজত্বকালের সময়সীমা ছিল সম্ভবত ৬০৬ থেকে ৬১২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর শাসন মালওয়া থেকে পশ্চিম ভারতের কচ্ছের মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর রাজত্বকালে বলভী শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। হিউয়েন সাঙ তাঁকে সুদক্ষ ও দয়ালু শাসক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রথম শিলাদিত্যের পরবর্তী দুজন রাজা প্রথম খড়গ্রহ ও তৃতীয় ধরসেন চালুক্য ও হর্ষবর্ধনের সাথে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
দ্বিতীয় ধ্রুবসেন ছিলেন থানেশ্বরের পুষ্যভূতি-বংশীয় হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক। তিনি বালাদিত্য নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মৈত্রক বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি। তিনি ব্যাকরণ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তিনি গুজরাট ও মালবের কিছু অংশ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত হন। হর্ষবর্ধন পরাজিত দ্বিতীয় ধ্রুবসেনের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দেন। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং হর্ষের আহ্বানে প্রয়াগের ধর্ম-সম্মেলনে যোগদান করেন।
মৈত্রক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন চতুর্থ ধরসেন। তাঁর রাজত্বকালে বলভী রাজ্য শক্তি ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ করে। তাঁর রাজ্যের সীমা ভূগুকচ্ছ বা বর্তমান ব্রোচ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি ‘পরম ভট্টারক’, ‘মহারাজাধিরাজ’, ‘পরমেশ্বর’, ‘চক্রবর্তিন’ প্রভৃতি সম্রাট-মর্যাদাজ্ঞাপক উপাধি ধারণ করেন। তাঁর রাজসভা শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। ‘ভট্টিকাব্যম’ বা ‘রাবণবধম’ কাব্য রচয়িতা কবি ভট্টি তাঁর সভাকবি ছিলেন। চতুর্থ ধরসেনের পর মৈত্রক বংশ আরও প্রায় একশো বছর রাজত্ব করেছিল।
চতুর্থ ধরসেনের পরবর্তী রাজারা হলেন তৃতীয় ধ্রুবসেন, দ্বিতীয় খড়গ্রহ, দ্বিতীয় শিলাদিত্য, তৃতীয় শিলাদিত্য, চতুর্থ শিলাদিত্য, পঞ্চম শিলাদিত্য, ষষ্ঠ শিলাদিত্য। এই সময় আরব আক্রমণ এবং চালুক্য, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট শক্তির উত্থানে অষ্টম শতকের তৃতীয় ভাগে মৈত্রক রাজবংশের পতন ঘটে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বলভী অতি উল্লেখযোগ্য ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে রাজধানী বলভী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিদেশে রপ্তানির জন্য এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর জন্য বলভীতে বহু গুদাম তৈরি হয়েছিল। অষ্টম শতকে ভূগুকচ্ছ (বর্তমান ব্রোচ) মৈত্রক রাজাদের দখলে এলে নতুন একটি বাণিজ্যকেন্দ্র তাদের হাতে আসে। ভৃগুকচ্ছ পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও বলভী উল্লেখযোগ্য ছিল। হিউয়েন সাঙ ও ইৎ সিং-এর মতে বলভী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান এবং পূর্ব ভারতের নালন্দার মতোই তার খ্যাতি বহুদুর বিস্তৃত ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে সমবেত হতেন। কেবলমাত্র বৌদ্ধশিক্ষাই নয়—এখানে উন্নত মানের ব্রাহ্মণ্য শিক্ষারও ব্যবস্থা ছিল। মৈত্রক রাজন্যবর্গ ও ধনী বণিক সম্প্রদায় এই শিক্ষাকেন্দ্রে অর্থ সাহায্য করতেন। এখানকার বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে স্থিরমতি ও গুণমতি উল্লেখযোগ্য ছিলেন।
বলভীর রাজারা শৈব ছিলেন। অনেকে আবার বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের পরধর্মসহিষ্ণু নীতির ফলেই বলভী বৌদ্ধশাস্ত্র শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।