আদি-মধ্যযুগের ভারতে সামুদ্রিক অভিযান কিছুটা অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বভাবতঃই চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ (Maritime Activities of the Cholas) বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এটি চোল রাজাদের কোন আকস্মিক রোমাঞ্চকর সিদ্ধান্ত ছিল না। যথেষ্ট পরিকল্পিত এবং পূর্ণ প্রস্তুতি সহ একাধিক চোল রাজা দুঃসাহসিক ও অভূতপূর্ব সামুদ্রিক অভিযানে লিপ্ত হয়েছিলেন। ৯৮৫-১১২০ পর্যন্ত চোলরা কার্যত বঙ্গোপসাগরকে ‘চোল হ্রদে’ পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ সূচনা করেন প্রথম রাজরাজ। তিনি চের বা কেরল রাজ্য আক্রমণ করে ‘কুন্দলুর-স্পালৈ-কলমরুন্ড’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম রাজরাজের অষ্টম রাজ্যবর্ষের লেখতে দাবি করা হয়েছে, তিনি উন্মুক্ত সমুদ্রে অবস্থিত ইলম জয় করেছিলেন। রাজেন্দ্র চোলের তিরুবলাঙ্গরু তাম্র পট্ট থেকে জানা যায়, প্রথম রাজরাজ ইলমণ্ডলম বা শ্রীলঙ্কা জয় করেন। বৌদ্ধগ্রন্থ দীপবংশ, মহাবংশতে বলা হয়েছে, চোলদের আক্রমণে সন্ত্রস্ত হয়ে সিংহল-রাজ পঞ্চম মহেন্দ্র দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সিংহলের উত্তরভাগ অর্থাৎ রাজরট দখল করে রাজরাজ তার নতুন নাম দেন ‘মুম্মুডি-চোলমণ্ডলম’। অতঃপর রাজরাজ সিংহলের রাজধানী অনুরাধপুর ধ্বংস করেন এবং পোলন্নরূব’তে সিংহলস্থ চোল প্রদেশের নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম রাজরাজ সিংহল বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পোলন্নরূব’তে একটি পাথরের শিবমন্দির নির্মাণ করেন। চোল নৌবহর সিংহলের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র মহাতীটঠ দখল করে তার নতুন নাম দেয় রাজরাজপুর।
প্রথম রাজরাজের শেষ উল্লেখযোগ্য সামুদ্রিক কার্যকলাপ ছিল ভারত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত মালদ্বীপ পুঞ্জের বিরুদ্ধে। রোমিলা থাপার মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে আরবদের প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য প্রথম রাজরাজ আরব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মালদ্বীপ পুঞ্জের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
রাজেন্দ্র চোলের প্রথম উল্লেখযোগ্য সামুদ্রিক কার্যকলাপ ছিল সিংহল আক্রমণ ও দখল। তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বর্ষের কয়েকটি লেখতে এই অভিযানের কথা উল্লেখ আছে। সিংহলী ইতিবৃত্ত মহাবংশ গ্রন্থে দাবি করা হয় যে চোলরা শ্রীলঙ্কায় বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। রাজার হীরের তৈরি অলংকার চোলরা দখল করে নেয়। মহাবংশ গ্রন্থে চোল সেনাবাহিনীকে রক্তপিপাসু মগ দস্যুদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রাজেন্দ্র চোল সমগ্র সিংহলকে (শ্রীলঙ্কা) চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রদেশে পরিণত করেন। মহাবংশে দাবি করা হয়েছে যে রাজা পঞ্চম মহেন্দ্রর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কশ্যপের নেতৃত্বে জাতীয় প্রতিরোধ তৈরি হয় এবং দীর্ঘ যুদ্ধের পর সিংহলের দক্ষিণ ভাগে তিনি নিজ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। প্রথম বিক্রমবাহু নাম নিয়ে তিনি বারো বৎসর দক্ষিণ সিংহল শাসন করেন।
রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বের দ্বাদশ বর্ষে একটি লেখতে দেখা যায় যে তিনি ভারতের পূর্ব উপকূলের উত্তরদিকে নৌ-অভিযান পাঠান। বেঙ্গী রাজ্যের সাথে যুদ্ধে কলিঙ্গ রাজ্য বেঙ্গীকে সাহায্য করলে ক্ষুব্ধ চোল-রাজ কলিঙ্গ দেশকে সমুচিত শাস্তি দিতে অগ্রসর হন এবং সসৈন্যে গঙ্গা নদীর মোহনা পর্যন্ত অগ্রসর হন। চোল সেনা বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে উড়িষ্যা, রায়পুর, বিলাসপুর, সম্বলপুর ও বঙ্গদেশ জয় করে গঙ্গার জল নিয়ে চোল রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে। রাজেন্দ্র চোল চতুর্দশ রাজ্যবর্ষে বিখ্যাত ‘কড়ারম’ (শ্রীবিজয়) অভিযান চালান। উত্তাল সমুদ্রে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে রাজেন্দ্র চোল কড়ারম শাসক সংগ্রাম বিজয়োতুঙ্গ বর্মনকে পরাজিত করেন। শ্রীবিজয় ছিল একটি সামুদ্রিক রাষ্ট্র। মালয় উপদ্বীপ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা এবং সন্নিহিত মোবিলিমবনগম, থলৈপ্পনদরু, তলৈটট্কোল্লম, মাদমালিঙ্গম, মানক্কবারম প্রভৃতি দ্বীপ-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য বিজিত কোন অঞ্চলকেই তিনি চোল রাজ্যের অঙ্গীভূত করেননি।
রাজাধিরাজ, দ্বিতীয় রাজেন্দ্র, বীর রাজেন্দ্র, অধিরাজেন্দ্র প্রমুখের রাজত্বকালে চোল নৌবহর ব্যবহার হয়েছিল মূলত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। সিংহলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালাচ্ছিল। সিংহলের রাজা প্রথম বিজয়বাহু চোল শাসনের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হলে বীর রাজেন্দ্র ১০৬৫ খ্রীষ্টাব্দে সিংহল আক্রমণ করেন। বীর রাজেন্দ্রর লেখতে দাবি করা হয় যে তিনি বিজয়বাহুকে পরাজিত করে সমগ্র সিংহলের উপর অধিকার পুনঃস্থাপন করেন।
চোলরাজ প্রথম কুলোতুঙ্গ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর শাসনকালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কোন অভিযান পাঠাননি। ১০৭০ খ্রীষ্টাব্দে সিংহল কার্যত চোল শাসন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। মহাবংশ গ্রন্থে উত্তর সিংহলের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কলিঙ্গাত্তুপ্পারনি গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে যে কুলোতুঙ্গ উন্মুক্ত সাগর অতিক্রম করে ‘কড়ারম’ অভিযান করেছিলেন।
চোল রাজারা দীর্ঘ ১৩৫ বছর ধরে পরাক্রান্ত নৌ-বহরের সাহায্যে সমুদ্রের বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্রে অভিযান চালান। কিন্তু একমাত্র সিংহল বা শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোন এলাকা তাঁরা স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয়। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে, রাজেন্দ্র চোল গঙ্গা অভিযান ভারতের পূর্ব-উপকূল বরাবর চালিত হয়েছিল, কারণ ওই উপকূলের সমৃদ্ধ বন্দর ও তার বাণিজ্যের উপর কর্তৃত্ব করাই ছিল তার লক্ষ্য। সাধারণভাবে, এ কথা বলা যায় যে, চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ বিশুদ্ধ লুণ্ঠন প্রবৃত্তি সঞ্জাত ছিল না। সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই একাধিক চোল নৃপতি সামুদ্রিক অভিযান কর্মসূচী গ্রহণে তৎপর ছিলেন।