রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌল ধারণা হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কর্মধারা বিশ্লেষণে মার্কসবাদ একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলা যায়। সমাজবিকাশের মৌল ধারণাগুলি বিশ্লেষণ করে মার্কসবাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনুধাবন করার কথা বলে।
◇ রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব: মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাষ্ট্র সমাজ-বহির্ভুত নয়, চুক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয় নি, ঈশ্বর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়, এমন কি কোন আত্মসচেতন নৈতিক সত্ত্বাও নয়, সমাজ বিকাশের এক নির্দিষ্ট অধ্যায়ে ঐতিহাসিক কারণেই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। লেনিন বলেছেন, অতীতে এমন এক সময় ছিল, যখন রাষ্ট্র ছিল না। সমাজ যখন বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সমাজে শোষক ও শোষিতের উদ্ভব হল তখনই রাষ্ট্র দেখা দিল। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে কার্ল মার্কস বলেন যে, ‘রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের যন্ত্র’, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি শ্রেণীকে শোষণ করার জন্যে অপর শ্রেণীর হাতিয়ার। কমিউনিষ্ট ইস্তাহারে বলা হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা হল কোন শ্রেণীর সংগঠিত ক্ষমতা। সমাজবিকাশের এক নির্দিষ্ট ভরে শ্রেণী বিভাজনের কারণে রাষ্ট্রের উদ্ভব, শ্রেণী বিভাজনের অবসানে রাষ্ট্রও অন্তর্হিত হবে।
রাষ্ট্র একটি বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠান এবং পুলিশ, সেনাবাহিনী, জেল, আইন-আদালতের মাধ্যমে শ্রেণী শাসন ও শ্রেণীশোষণ বলবৎ থাকে। এর ব্যাখ্যা করে মার্কস বলেছেন, সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে শ্রেণীসংগ্রাম হল মানব সমাজের ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য। মানব সমাজের ইতিহাস বলতে মার্কস ও এঙ্গেলস লিখিত ইতিহাসের কথাই বলেছেন। আদিম সমাজজীবনের কথা বলেন নি। আদিম যৌথ জীবনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, উৎপাদন ব্যবস্থা জটিল ছিল না, শ্রেণী বিভাজন না থাকায় শোষণের হাতিয়ারেরও প্রয়োজন ছিল না। আদিম যৌথ জীবন সাম্যভিত্তিক ছিল, তাই একে ‘আদিম-সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করা হয়। সমাজে দাসত্ব প্রথা চালু হলে সেই প্রথাভিত্তিক সমাজে প্রথম দাস-মালিক ও ক্রীতদাসের মধ্যে সামাজিক শ্রেণী বিভাজন দেখা দিল। সামন্তযুগে সমাজ দ্বন্দ্বশীল সামন্তপ্রভু বা জমিদার এবং ভূমিদাসের মধ্যে বিভক্ত হয়। সামন্ত সমাজব্যবস্থার পতনে ধনতান্ত্রিক অর্থাৎ বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য নতুন রূপ গ্রহণ করল। সমাজ পুঁজিপতি ও সর্বহারায় বিভক্ত হল। সকল স্তরেই দাস মালিক, সামন্তপ্রভু এবং ধনিক বা বুর্জোয়া শ্রেণী আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও শ্রেণীশোষণ অব্যাহত রাখতে বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সমাজের বিকাশের প্রতি অধ্যায়ে রাষ্ট্রের শোষণমূলক চরিত্র থেকে গেল, ধনতান্ত্রিক সমাজে বুর্জোয়া ও সর্বহারার স্বন্দ্ব চরম রূপ লাভ করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণী কৃষক ও জনগণের সহযোগিতায় বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সর্বহারা বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে রাষ্ট্র হল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিক মালিকানা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমাজে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকবে না। প্রত্যেকে আপন সামর্থ অনুযায়ী কাজ করবে এবং যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। এই সমাজে মালিক-শ্রমিকের ভেদ থাকবে না, শোষণ থাকবে না, তাই শ্রেণীশোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও বিলুপ্ত হবে।
◇ সমালোচনা: উদারনৈতিক দর্শনের সমর্থক বুর্জোয়া লেখকগণ রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসবাদী ব্যাখ্যার অসম্পূর্ণতা ও যুক্তিহীনতার কথা বলেন। তাঁদের মতে—
প্রথমত, সমাজের বিকাশে মার্কস অর্থনৈতিক উপাদানের ওপর মানসিক প্রাধান্য দিয়েছেন। সমাজ বিবর্তনে মানুষের প্রবৃত্তি, প্রক্ষোভ, মতাদর্শ, ধর্ম কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের জীবনে উদরপূর্তির চিন্তাই সব নয়, আদর্শের জন্যে মানুষ যুগে যুগে যে সংগ্রাম করেছেন, মার্কসবাদ তাকে উপেক্ষা করে।
দ্বিতীয়ত, শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাটিও একমাত্র সত্য নয়। ইতিহাসে শ্রেণী দ্বন্দ্বের সঙ্গে শ্রেণী সহযোগিতার বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তও কম মেলে নি।
তৃতীয়ত, মার্কসবাদ শ্রেণীসংগ্রাম প্রধান মনে করে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণাকে প্রশ্রয় দেয়। হিংসা, দ্বেষ, হানাহানির মাধ্যমে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সমাজে উত্তরণ সম্ভব নয়।
চতুর্থত, সর্বহারা বিপ্লবের পরে শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে-এই ধারণাকেও অনেকে মানেন না। আধুনিক বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ্য করে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের বিলুপ্তির সম্ভাবনা কম।
◇ মূল্যায়ন: বর্তমান বিশ্বে সমাজকল্যাণ বা জনকল্যাণ রাষ্ট্রে কর্মকাণ্ড মার্কবাদী দৃষ্টিকে অস্বীকার করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ইতিবাচক ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা, কর্ম ও মজুরীর ব্যবস্থা করার কাজ যখন রাষ্ট্র করছে, তখন তাকে শ্রেণী-শোষণের সূত্র বলা যায় না। মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে প্রমাণ করেছে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার।