অধ্যাপক অ্যালান বল তার ‘Modern Politics and Government’ গ্রন্থে প্রতিনিধিত্বের সমস্যা এবং আধুনিক তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুটি মৌল ধারণার ওপর প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিশীল। প্রথম ধারণা অনুযায়ী সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত, সুতরাং সরকারকে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়। দ্বিতীয় ধারণা অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে সংখ্যালঘিষ্ঠের ইচ্ছা অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। ফরাসী দার্শনিক রুশো সার্বভৌম ক্ষমতার হস্তান্তর বা কারও মাধ্যমে এর প্রকাশ স্বীকার করেন নি। রুশো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তিনি ব্রিটিনের জনগণের নির্বাচনের সময় ছাড়া অপর সময় কোন স্বাধীনতা স্বীকার করেন নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দ ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার ধারণা অস্বীকার করে ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে বিশেষ অনিচ্ছা সহকারেই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থান দেন। সুতরাং উনবিংশ শতাব্দীর আগে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন—এই ধারণার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের তত্ত্ব নির্ধারণ বিশেষ কষ্টসাধ্য ছিল। সমস্ত দিক বিবেচনা করে অধ্যাপক বল প্রতিনিধিত্বের আধুনিক তত্ত্বকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, যথা—(ক) উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব (liberal democratic theories) এবং (খ) সমষ্টিবাচক তত্ত্ব (collectivist theories)।
(ক) প্রতিনিধিত্বের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব
(১) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রাধান্য: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্বগুলি ব্যক্তির অধিকার, বিশেষত বাক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। এ অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকারী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এ তত্ত্ব স্বীকার করে। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাপত্রে মানুষের কতকগুলি অপরিত্যাজ্য অধিকার স্বীকার করা হয়। সুতরাং উদারনৈতিক গণতন্ত্র ভোটাধিকারের সম্প্রসারণের সঙ্গে ভোটাধিকারের সমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিনিধি ব্যক্তির মতামত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এক নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা সমন্বিত নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করে, কোন বিশেষ শ্রেণী পেশা বা স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না।
(২) মানুষকে যুক্তিবাদী বলে গ্রহণ করে: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব মানুষকে যুক্তিবাদী বলে স্বীকার করে নেয়। মানুষ যুক্তিবাদী বলে আপন স্বার্থ ও মতামত সম্পর্কে যেমন সচেতন, সমাজের বৃহত্তর দাবি সম্পর্কেও সচেতন। সুতরাং মানুষ যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার দ্বারা প্রতিনিধি নির্বাচনে সার্থকভাবে ভোটদান করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা টমাস জেফারসন (Thomas Jefferson) মার্কিন শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত ব্যক্তির নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাকে প্রধান বলে গণ্য করেন। উনবিংশ শতাব্দীর ধ্রুপদী উদারনৈতিকগণ জেফারসনের অভিমতকেই সমর্থন করেন।
(৩) সর্বজনীন ভোটাধিকার: এই তত্ত্ব অনুসারে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমেই জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ হতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে বিভিন্ন সংস্কারমূলক আইনেই ক্রমপর্যায়ে নির্বাচনী এলাকার প্রসার, গোপন ভোট পদ্ধতির প্রবর্তন, নির্বাচনে দুর্নীতিমূলক উপায়ের, প্রতিরোধ, লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
(৪) প্রতিনিধির ব্যক্তিগত মতামতের মূল্য স্বীকারঃ তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিনিধির বিশেষ ভূমিকার গুরুত্ব স্বীকার করা হয়। প্রতিনিধি তার নির্বাচকমণ্ডলীর নিকট দায়িত্বশীল থাকলেও নির্বাচকগণের আদেশবাহক মুখপাত্র হিসাবে কাজ করবেন না। প্রতিনিধি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার সম্মিলিত মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু তার ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনা বিসর্জন দেবার প্রয়োজন নেই বলে মনে করা হয়। অবশ্য প্রতিনিধিগণ নিজস্ব বিচার- বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবার সঙ্গে নির্বাচনী এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিকেও উপেক্ষা করবেন না।
(৫) সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব স্বীকার: প্রতিনিধিত্বের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্বশাসন বিভাগের অকাম্য ক্ষমতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ রোধের জন্য প্রতিনিধিমূলক আইনসভার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। প্রতিনিধিমূলক আইনসভা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রকাশ করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারী মনোভাব প্রতিফলিত হতে পারে। এই সমস্যা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলেকজান্ডার হ্যামিলটন মার্কিন সংবিধানের প্রণয়নের সময়ে অভিমত প্রকাশ করেন যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ক্ষমতাপ্রিয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর ক্ষমতা অর্পণ করলে সংখ্যালঘিষ্ঠ অত্যাচারিত হবে। আবার সংখ্যালঘুর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর অত্যাচার করবে। সুতরাং উভয়ের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। অশিক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের আশঙ্কায় শিক্ষিত এবং বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তির ভোটাধিকারের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। বর্তমান সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের জন্য মার্কিন লেখক রবার্ট ডাল সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। ডালের মতে, এর দ্বারাই রাজনৈতিক সাম্য এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব হবে।
(খ) প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্ব
(১) সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্য স্বীকার: সমষ্টিবাচক প্রতিনিধিত্ব তত্ত্ব সংখ্যালঘিষ্ঠের পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই তত্ত্ব জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে। লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি এবং মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্বকে কার্যক্ষেত্রে সার্থকভাবে রূপায়িত করতে সমর্থ হয়েছে।
(২) সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা—শোষণের অবসান: বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এই গণতন্ত্র অপেক্ষা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা উন্নততর গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছে। শ্রেণী শোষণের অবসান ছাড়া গণতন্ত্র সার্থক হতে পারে না। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক সমতা স্বীকৃত হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার অভাবে প্রতিনিধিত্বব্যবস্থা কার্যতঃ গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করে। সামাজিক সাম্য এবং অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সমষ্টিবাচক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে তা সম্ভব হয়েছে।
(৩) একদলীয় ব্যবস্থা স্বাভাবিক: বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বিভিন্ন শ্রেণী-স্বার্থের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব এবং নির্বাচনে বিভিন্ন দলীয় প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রেণীস্বার্থের দ্বন্দ্ব না থাকায় এবং শ্রেণী-শোষণের অবসান ঘটায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয় না। প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন ওঠে না। সাম্যবাদী দলই জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যাপক স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং রাষ্ট্রের সংস্থা (organs of state) জনগণের নিকট থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে।
(৪) আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব স্বীকার: সমষ্টিবাচক প্রতিনিধিত্ব পেশাগত এবং বৃত্তিগত নির্বাচন অপেক্ষা আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্বের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। এই তত্ত্বের দ্বারাই সমাজতান্ত্রিক দেশে আইনসভা যথার্থ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এবং প্রতিনিধিও নির্বাচনী এলাকার সামাজিক সমস্যাগুলিকে যথাযথ প্রতিফলিত করতে সমর্থ হয়। সমষ্টিবাচক তত্ত্বের এখানেই সার্থকতা।