ভারতে সুলতানি যুগের মুদ্রা ব্যবস্থা বেশ পরিশীলিত ছিল। তুর্কী শাসনের আগে ভারতীয় মুদ্রার একপাশে রাজা বা রাজার মস্তিষ্কের ছবি এবং অন্যপাশে দেব-দেবী, পশু-পাখি ইত্যাদির খোদিত অলংকরণ করা থাকত। দিল্লীতে তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় মুদ্রার ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ইসলাম ধর্মের রীতি মান্য করে মুদ্রায় দেব-দেবী বা মানুষের মূর্তি বা পশু-পাখির ছবি খোদাই করা নিষিদ্ধ হয়। পরিবর্তে লোককথা বা নীতিবাক্য খোদাই করার রীতি চালু হয়। ইসলামের ধর্মীয় বাণী ‘কলিমা’ ও খলিফার নামে একপাশে উৎকীর্ণ করা হত এবং অপর পার্শ্বে সুলতানের নাম, উপাধি ও খোদাই করার তারিখ উৎকীর্ণ থাকত।
মুদ্রার ওজন ও মানের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। মুদ্রার মান হিসেবে ‘তোলা’র প্রচলন হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা-উভয়ক্ষেত্রে নানা ‘একক’-এর প্রচলন করা হয়। অর্থাৎ তুর্কো-আফগান শাসনকালে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবস্থার প্রকৃতি গঠনে মধ্য-এশিয়ার মুদ্রা ব্যবস্থার বিশেষ প্রভাব ছিল। আদি-মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের মুদ্রার প্রাচীন ভারতীয় রীতির কিছু প্রভাব দেখা যায়। যেমন, গজনীর সুলতান মামুদ ১৪৪০ খ্রীষ্টাব্দে (হিজরী সন ৪১৮-১৯) যে মুদ্রা চালু করেন তাতে হিন্দু প্রভাব স্পষ্ট। এই মুদ্রায় প্রথম পিঠে আরবী শব্দে ‘কলিমা’ খোদাই করা ছিল। এবং অন্য পিঠে কলিমার সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদসহ রাজার নাম (মামুদ), খোদাই স্থান (মামুদপুর অর্থাৎ লাহোর) এবং খোদাই করার সন (হিজরী ৪১৮ ১৯) ইত্যাদি উৎকীর্ণ করা ছিল। সম্ভবত, এটিই একমাত্র মুদ্রা যেখানে ‘কলিমা’র সংস্কৃত অনুবাদ পাওয়া যায়। মহম্মদ ঘুরীর কিছু মুদ্রায় রাজপুত রীতি অনুসারে দেবী লক্ষ্মীর খোদিত মূর্তি লক্ষ্য করা যায়। আদি-মধ্যযুগে প্রধানত তামা ও ব্রোঞ্জের মুদ্রা চালু ছিল। রৌপ্যমুদ্রা ছিল নগণ্য এবং স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল না।
সুলতানি আমলে মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলে ভারতে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ঘটে। এই সময় সুলতান ইলতুৎমিস রৌপ্য টংকার প্রবর্তন করেন। একটি টংকার আকার ছিল গোল এবং সম্মুখভাগে ছিল অশ্বরূঢ় রাজার। এখানে একটি চতুষ্কোণের মধ্যে আরবী শব্দে খোদিত ছিল ‘সর্বশক্তিমান সুলতান, বিশ্বের আলোক ও বিশ্বাসের উৎস, বিজয়ীদের নেতৃস্বরূপ, সুলতান ইলতুৎমিস’। এই মুদ্রার ওজন ছিল ১৬৫ গ্রেন। ১২২৮ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের পর তিনি আর এক ধরনের মুদ্রা চালু করেন যা ইসলামিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মুদ্রা সম্পূর্ণরূপে হিন্দু-প্রভাব রহিত। এর একদিকে মহান খলিফা ও অন্যদিকে সুলতান ইলতুৎমিসের গুণকীর্তন করা হয়েছে। আলাউদ্দিন খলজীর আমলে রৌপ্য মুদ্রায় খলিফার নাম খোদাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে দক্ষিণ ভারত জয়ের সূত্রে তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তাই তিনি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। অবশ্য তিনি পরোক্ষভাবে খলিফাকে সম্মান জানান। তাঁর মুদ্রায় উৎকীর্ণ বাণী ছিল “দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, খলিফার দক্ষিণ হস্ত এবং বিশ্বাসীদের প্রধান সেনাপতি।” কুতুবউদ্দিন মুবারক নিজ মুদ্রায় সুলতানকে ‘ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা’, ‘স্বর্গ ও মর্ত্যের খলিফা’, ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি (খলিফা)’ এবং ‘প্রধান ইমাম’ ইত্যাদি উপাধিতে বর্ণনা করেন।
সুলতানি আমলে রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার পাশাপাশি রূপা ও তামার সংমিশ্রণে নতুন মুদ্রার (Billion) প্রচলন হয়। এই মুদ্রার ওজন ছিল ৫৬ গ্রেইন। তবে মুদ্রায় রূপা ও তামার অনুপাত অনুসারে মুল্যের তারতম্য ঘটত। এই মুদ্রার আকৃতি ও ওজন ছিল প্রায় একই রকম। ‘দেহলিওয়ালা’ নামক মুদ্রার একদিকে চৌহান বংশীয় মুদ্রার অনুকরণে ‘অশ্বারূঢ় ব্যক্তি’ এবং অন্যদিকে কুঁজবিশিষ্ট বৃক্ষের প্রতিকৃতি এবং ‘নাগরী’ অক্ষরে সুলতানের নাম খোদাই করা থাকত। কোন কোন ক্ষেত্রে আরবী হরফ ব্যবহৃত হত। সুলতান রাজিয়ার একটি স্বর্ণ মুদ্রার একপৃষ্ঠে এক অশ্বারূঢ় ব্যক্তিকে ঘিরে নাগরী রীতিতে লেখা ছিল ‘শ্রী হামির’ (আমীর) এবং অন্যপৃষ্ঠে আরবীতে রাজিয়ার নাম খোদিত ছিল। এর ওজন ছিল ৫৪ গ্রেইন। বলবন ৫৫ গ্রেইন যুক্ত মুদ্রা চালু করেন। এর একদিকে মাঝখানে গোলাকারে সুলতানের নাম খোদিত ছিল। অন্যদিকে সুলতানের নাম ও উপাধি খোদিত থাকে। কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ চতুষ্কোণ বিশিষ্ট মুদ্রা প্রচলন করেন। এর একদিকে ‘ঘটশ্বরের খলিফা, মুবারক শাহ এবং অন্যদিকে ‘আল্লাহর অনুগত সুলতান, বিশ্বাসীদের নেতা’ খোদিত ছিল। এই মুদ্রার ওজন ছিল ৮০ গ্রেইন। আলাউদ্দিন খলজী সর্বপ্রথম প্রকাশের তারিখসহ বিলিয়ন মুদ্রা চালু করেন। ইলবেরী তুর্কীদের তাম্র মুদ্রায় সুলতানের নাম থাকলেও তারিখ দেওয়া হত না। কিছু মুদ্রায় কেবল ‘আদিল’ কথাটি থাকত।
মহম্মদ-বিন-তুঘলকের যুগে মুদ্রা-বৈচিত্র্যের দিক থেকে সর্বাধিক আকর্ষণীয় ছিল। তাঁর মুদ্রার আকৃতি ও খোদাই কর্ম ছিল খুবই উন্নতমানের। তিনি বিভিন্ন মানের বহু স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। মুদ্রা ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাঁর নাম ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। শাসনকালের সূচনায় তিনি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ১৭২.৮ গ্রেইন-এর স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা চালু রাখেন। দক্ষিণ ভারত অভিযানের সুত্রে উত্তর ভারতে সোনা-রূপার অন্তঃপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় মুদ্রার মূল্যমান হ্রাস হলে তিনি রাজাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সোনা ও রূপার মুদ্রার ওজন কমিয়ে ২০১.৬ ও ১৪৪ গ্রেইন করে দেন। স্বর্ণমুদ্রা ‘দিনার’ ও রৌপ্যমুদ্রা ‘আদলি’ নামে পরিচিত হয়। অবশ্য নির্ধারিত ওজনের কমেও কিছু কিছু মুদ্রা পাওয়া যায়। ৭২৬ হিজরী সনের একটি স্বর্ণ মুদ্রার ওজন ছিল ১৯৯ গ্রেইন। মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে প্রায় ছয় ধরনের স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা চালু ছিল। রৌপ্য ও তামা মিশ্রিত (Billion) মুদ্রার পরিবর্তে তামা ও পেতলের (Copper and Bronz) মুদ্রা প্রচলনের প্রয়াস। আনুমানিক ১৩২৯ থেকে ১৩৩২ খ্রীষ্টাব্দের (হিজরী সন ৭৩০ ৭৩২) অন্তর্বর্তীকালে তাঁর প্রতীকি মুদ্রা চালু ছিল। কিন্তু এমন স্বল্পমূল্যের ধাতু নির্মিত প্রতীক মুদ্রা ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়।
ফিরোজ তুঘলকের মুদ্রায় বিশেষ নতুনত্ব ছিল না। তবে খলিফার প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য হেতু তাঁর আমলের মুদ্রার একপিঠে খলিফাদের নামোল্লেখ থাকত এবং অন্যপিঠে খলিফার সেবক হিসেবে সুলতানের নাম খোদাই করা থাকত। তাঁর (Billion) মুদ্রার ওজন ছিল ১৪৪ গ্রেইন। ফিরোজের পরবর্তীকালে ভারতে সোনা-রূপার আমদানি হ্রাস পেলে শুধুমাত্র তামা ও রূপার Billion কিংবা তামার মুদ্রা চালু থাকে। লোদী সুলতানদের মুদ্রায় জৌনপুরের শার্কী শাসকদের মুদ্রা ব্যবস্থার বিশেষ প্রভাব ছিল। ‘বহুমুখী’ মুদ্রার ওজন ছিল ১৪৫ গ্রেইন। দিল্লী ও জৌনপুর থেকে তাঁদের মুদ্রা প্রচলিত হত।