জাতীয় নেতারা অনেক আশা-ভরসা নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রায় দশ লক্ষ ভারতীয় মিত্র সেনাদলে যোগ দিয়েছিল। বিনিময়ে ব্রিটেন তথা মিত্রপক্ষের দেশগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, বিশ্বের পরাধীন জাতিগুলিকে তারা জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেবে। জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মিলিতভাবে দাবি পেশ করেছিল যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকা অবস্থায় যেন শাসকরা ভারতীয়দের স্বরাজ ও স্বাধিকার মেনে নেয়।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের পটভূমি
হোমরুল আন্দোলনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ভারতে স্বরাজের দাবি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অন্যদিকে কৃষক ও শ্রমিকরাও তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও মহাজনদের মধ্যে বিক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হলে ব্রিটিশ সরকারের ভেদনীতি আপাততঃ অকার্যকরী হয়ে পড়ে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে কংগ্রেসি আন্দোলনের দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রমাণিত হয়েছিল যে, জাতীয় কংগ্রেস প্রয়োজনে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে সমর্থ। অন্যদিকে তুরস্কের প্রতি ইংল্যান্ডের আচরণ মুসলিম লিগকেও ইংরেজদের ওপর বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। এইরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে, দমননীতির সাহায্যে ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে স্তব্ধ করা সম্ভব নয়।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের শর্তাবলী
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ভারতে শাসন সংস্কারের জন্যে ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন’ পাস করে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের পশ্চাতে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ভারত সচিব মন্টেগু ও বড়লাট চেমসফোর্ড। এজন্য তাঁদের নাম অনুসারে এই আইনটিকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন বলা হয়। উদারপন্থী সাম্রাজ্যবাদী গবেষকরা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনটিকে ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ববোধ ও শুভেচ্ছার নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের শর্তাবলীগুলি হল—
(i) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা ভাগ করা হয়। বৈদেশিক নীতি, শুল্ক, মুদ্রা, দেশরক্ষা, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন, যোগাযোগ, অর্থ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে রাখা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলসরবরাহ, দুর্ভিক্ষ, ত্রাণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বিষয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের এক্তিয়ারে রাখা হয়।
(ii) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে কেন্দ্রে দুইকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। উচ্চকক্ষের নাম হয় ‘কাউন্সিল অফ স্টেট’ এবং নিম্নকক্ষের নাম হয় ‘লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলী’।
(iii) কাউন্সিল অফ স্টেটে ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ৩৩ জন নির্বাচিত ও ২৭ জন মনোনীত সদস্য রাখার ব্যবস্থা হয়। নির্বাচিত ৩৩ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন মুসলিম সদস্য স্বতন্ত্র মুসলিম ভোটে, ৩ জন ইউরোপীয় সদস্য, ১ জন শিখ, অন্যান্য ২ জন স্বতন্ত্র ভোটে এবং ১৬ জন সদস্য সাধারণ ভোটে নির্বাচিত হবেন। মনোনীত ২৭ জন সদস্যের মধ্যে ১৭ জন সরকারি কর্মচারী ও ১০ জন বেসরকারি সদস্য হবেন। নির্বাচিত সদস্যরা ৫ বছরের জন্যে পদ ভোগ করবেন। কাউন্সিল অব ষ্টেটের সভাপতি বড়লাটের দ্বারা মনোনীত হবেন। বড়লাট এই সভা আহ্বান, মূলতুবী অথবা ভেঙে দিতে পারতেন।
(iv) লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলীতে ১৪৫ জন সদস্য থাকার ব্যবস্থা হয়। এর মধ্যে ১০৪ জন সদস্য নির্বাচিত ও ৪১ জন সদস্য মনোনীত হবেন। নির্বাচিত ১০৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫২ জন সাধারণ ভোটে, ৩২ জন সাম্প্রদায়িক ভোটে, ২০ জন বিশেষ শ্রেণীর ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই ২০ জনের মধ্যে ৭ জন জমিদার শ্রেণীর, ৯ জন ইউরোপীয় বণিক এবং ৪ জন ভারতীয় বণিক সভার প্রতিনিধিত্ব করবেন। নিম্নকক্ষের সদস্যরা ৩ বছরের জন্যে নির্বাচিত হবেন।
(v) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে বলা হয় যে, সম্পত্তির ওপর আয়কর প্রদানের ভিত্তিতে ভোটাধিকার দান করা হবে। মাথা পিছু ভোটের ব্যবস্থা ছিল না। প্রদেশগুলির লোকসংখ্যার অনুপাতে সদস্য সংখ্যা স্থির না করে প্রদেশগুলির গুরুত্ব অনুযায়ী সদস্য পদের সংখ্যা স্থির করা হয়।
(vi) কেন্দ্রীয় আইনসভায় বাজেট প্রস্তাব পেশ করার ব্যবস্থা হয়। গভর্ণর জেনারেলের অনুমতি ছাড়া বাজেটের কোন কোন বিষয় সদস্যরা আলোচনা করতে পারতেন না। বাকি প্রস্তাবগুলির ওপর সদস্যরা ছাটাই অথবা বাতিলের জন্যে সংশোধনী দিতে পারতেন। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল যদি মনে করতেন যে, ভারতের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে এই ব্যয় দরকার, তাহলে তিনি জরুরী দরকারবশতঃ বাজেটের বরাদ্দ পাশ করে দিতে পারতেন।
(vii) প্রাদেশিক শাসনের ক্ষেত্রে “ডায়ার্কি” (Dyarchy) বা দ্বৈত-শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। প্রাদেশিক সরকারের হস্তগত বিষয়গুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়— সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত। সংরক্ষিত বিষয়গুলি যথা— ভূমি-রাজস্ব, জলসেচ, দুর্ভিক্ষ, ত্রাণ, আইন-শৃঙ্খলা, শিল্প, সংবাদপত্র, সরকারি ঋণ গ্রহণ নীতি, পুলিশ প্রভৃতি প্রাদেশিক গভর্ণরের হাতে ন্যস্ত হয়। হস্তান্তরিত বিষয়গুলি যথা— জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বায়ত্ব-শাসন, কৃষি, মৎস্য চাষ, আবগারী, ধর্মীয় অনুদান, পাঠাগার প্রভৃতি মন্ত্রীসভার হাতে ন্যস্ত করা হয়। মন্ত্রীরা তাঁদের দপ্তরের কাজের জন্যে প্রাদেশিক আইনসভা ও গভর্ণরের কাছে দায়ী থাকবেন।
(viii) প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলায় ১৪০, মাদ্রাজে ১৩২, বোম্বাইয়ে ১১৪, উত্তরপ্রদেশে ১২৩ জন করা হয়। বলা হয় সদস্যদের মধ্যে অন্ততঃ ৭০% নির্বাচিত সদস্য থাকবেন। সরকারি কর্মচারী সদস্যের সংখ্যা ২০% এবং বাকি ১০% ছিলেন বেসরকারি মনোনীত সদস্য।
(ix) উচ্চ সম্পত্তি ভোগীরা আয়করের ভিত্তিতে ভোটাধিকার পায়। তাঁদের প্রদত্ত ভোটে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা নির্বাচিত হন। মুসলিম প্রতিনিধিরা মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ভোটে নির্বাচিত হবেন। সদস্যরা ৩ বছরের জন্যে নির্বাচিত হন। গভর্ণর জরুরী মনে করলে আইনসভা রদ বা মুলতুবী বা ভেঙে দিতে পারতেন। গভর্ণরের অনুমোদন ছাড়া আইনসভার কোন আইন সিদ্ধ হত না।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের গুরুত্ব
অধ্যাপক জি. এন. সিং করেছেন যে, মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার শর্তগুলিকে ভারতে স্বায়ত্ব-শাসন ব্যবস্থার প্রথম ধাপ বলা চলে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন দ্বারা নির্বাচকদের সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং আইনসভায় নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থাপিত হয়। মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন দ্বারা আইন রচনা ও প্রশাসনিক অধিকারের সীমারেখা ভেঙে ফেলা হয়। প্রদেশের ক্ষেত্রে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করে প্রশাসনিক দায়িত্ব মন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ দ্বারা জনসাধারণের রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ ঘটে। ভারতীয় মন্ত্রীরা হস্তান্তরিত দপ্তরের দায়িত্ব লাভ করে ভারতীয় সামাজিক অন্যায় ও দুর্নীতিগুলি দূর করতে সচেষ্ট হন। প্রদেশে ভারতীয়দের মন্ত্রী নিয়োগ করে সরকারের ভারতীয়করণের পথ প্রশস্ত করা হয়।
মূল্যায়ন
বাল গঙ্গাধর তিলক মন্তব্য করেন যে, “আইনটি একটি সূর্যালোকহীন প্রভাতের সৃষ্টি করেছে”। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতীয়দের ন্যূনতম আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। কারণ—
(ক) মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে সরকারি প্রাধান্যকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কারণ আইনসভার সিদ্ধান্তকে নাকচ করার অধিকার ছিল কেবলমাত্র বড়োলাট ও ছোটোলাটের।
(খ) ভোটের অধিকারকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল যাতে কোনো ভারতীয়ের গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য সফল না হয়।
(গ) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন সম্প্রদায়গত প্রতিনিধিত্বকে কেবল অন্তর্ভুক্তই করেনি তাকে আরও ব্যাপক করেছিল।
(ঘ) তিলক আইনের সমালোচনা করে একে গ্রহণের অযোগ্য বলেছিলেন। কংগ্রেসের চরমপন্থীরা মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনকে “অসন্তোষজনক, অপ্রচুর ও হতাশাজনক” বলে সমালোচনা করেন।