মুঘল সম্রাটরা সংগীত ও নৃত্যকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মুঘল দরবারে শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ও গুণী শিল্পীদের আহ্বান করা হত এবং সম্মান জানান হত। স্বয়ং বাবর সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তুর্কী ভাষায় কয়েকটি গান রচনা করেন। হুমায়ুন প্রতি সোম ও বুধবার সংগীতজ্ঞদের আলাপ শুনতেন। এই প্রবন্ধে, আমরা মুঘল যুগের সংগীত চর্চা (Music in the Mughal Age) সম্পর্কে আলোচনা করব।
আবুল ফজলের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সম্রাট আকবর সংগীতজ্ঞদের বিশেষ খাতির করতেন। হিন্দু, ইরানী, কাশ্মীরি বহু সংগীতজ্ঞ ও নৃত্যে পারদর্শীদের সঙ্গে তিনি সময় কাটাতেন। সম্রাট গানের তান, লয়, রাগ, রাগিনী ভালভাবে বুঝতেন এবং নিজে ভাল “নাকাড়া” বাজাতেন। তানসেন গোয়ালিয়র ঘরানার ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠা করেন। তানসেনের রাগ, রাগিনীর আলাপ ও মুর্ছনা দরবারে বিহ্বলতা সৃষ্টি করত। তানসেন হিন্দি ভাষায় অনেকগুলি গান লিখেছিলেন। আকবরের সভাসদ আবদুর রহিম খান-ই-খানান গান তৈরি করে সুর দিতেন। রাজা ভগবান দাস ও মানসিংহ সংগীতপ্রেমী ছিলেন। আকবরের প্রভাবে এবং বিখ্যাত গুণীদের চেষ্টায় হিন্দুস্থানী বা উচ্চাঙ্গ সংগীতে বহু রাগ ও রাগিনীর সৃষ্টি হয়। আকবরের সময়কালীন বিখ্যাত সাধক সংগীতজ্ঞদের নাম ছিল বৈজুবাওরা, তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামী, সুরদাস প্রভৃতি।
জাহাঙ্গীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলার অনুরাগী ছিলেন। নুরজাহান বেগম ছিলেন কলাকারদের পৃষ্ঠপোষিকা। শাহজাহান ছিলেন নিজে সংগীতের অনুরাগী। তিনি হিন্দি ভাষায় গান রচনা করে গাইতেন। তার গলার স্বর মধুর ছিল। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ শাহ ছিলেন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ। শাহজাহানের দরবারে জগন্নাথ, জনার্দন ভট্ট প্রভৃতি গায়করা খ্যাতি পান। ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে বসে ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য দরবারে সংগীত ও নৃত্য নিষিদ্ধ করেন। তিনি গায়ক ও নর্তক-নর্তকীদের দরবার থেকে বহিষ্কার করেন। আমীর ওমরাহরা গোপনে সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
জাহান্দার শাহের আমলে ‘তুফাৎ-উল-হিন্দ’ নামে সংগীত বিষয়ক গ্রন্থ লেখা হয়। রাজ-পরিবারের সদস্যরা এবং হারেমের মহিলারা সংগীত চর্চা বন্ধ করেন নি। মহম্মদ শাহের শাসনকালে সংগীতের উন্নতি হয়। মহম্মদ শাহের দুজন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছিলেন নিয়ামত খান সদারঙ ও ফিরুজ খান অদারঙ। তাঁরা ছিলেন ধ্রুপদের পণ্ডিত। মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ ‘রঙিলা পিয়া’ ছদ্মনামে খেয়াল রচনা করতেন। মুঘল যুগে সংগীতের সহযোগী বাদ্য হিসাবে স্বরমণ্ডল, বীন, কারানা, তাম্বুরা, নাকাড়া, খিচক, সুর্ণা ইত্যাদি ব্যবহৃত হত।
মুঘল দরবারের বাইরে সংগীতের প্রসার ঘটেছিল। সংগীতশাস্ত্র সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলির মধ্যে — গীত প্রকাশ, সংগীত কৌমুদি, সংগীত সরণী প্রভৃতি গ্রন্থ বিখ্যাত। মেবারের সংগীতজ্ঞ কুম্ভকর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন ‘সংগীতরাজ’। দক্ষিণে তামিল কবি ভক্তিধর্মের সাধক শৈব নায়নার এবং বৈষ্ণব আলভার সত্তরা বহু সংগীত রচনা করেন। তিরুপতির মন্দিরে ‘তাল্লাপক্কম’ নামে ভক্তি সংগীতের সংকলন তামার পাতে খোদাই করে রক্ষা করা হয়। মহাত্মা ত্যাগরাজা, মুন্ডুস্বামী দীক্ষিতার, শ্যামা শাস্ত্রী দক্ষিণী রাজ্যকে ধ্রুপদী চরিত্র দান করেন।