বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বর্তমানের গতিশীল যুগের সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। বিগত ৭০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক সমাজের অভাবনীয় পরিবর্তন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে বিপুল প্রসারিত করেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এলাকা বা বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা বা সীমানা নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে এশিয়া আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের ফলে পুরানো পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আবার উপনিবেশিক শক্তি পুরানো আধিপত্য বিস্তারের জন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা ক্ষেত্র তাই বহুবিস্তৃত এবং পরিবর্তনশীল। যুদ্ধ, আন্তর্জাতি কসম্মেলন, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, কুটনীতি, বৈদেশিক সাহায্য, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, বিমান ছিনতাই-এর ঘটনা—সব কিছুকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন মত: আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এখনও জাতি-রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্র কেন্দ্রিক। কিন্তু বর্তমানে অনেক সংগঠনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন।
১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা (UNESCO) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মরগেনথাউ (H. J. Morgenthou) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৫৪ সালে ভিনসেন্ট বেকার (Vincent Baker) এক সমীক্ষায় ৭টি বিষয়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় বলে মনে করেছেন। এগুলি হল—
- আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রকৃতি ও প্রধান নীতিসমূহ,
- আন্তর্জাতিক জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন,
- জাতীয় ক্ষমতার উপাদান,
- জাতীয় স্বার্থ সম্প্রসারণের মাধ্যমগুলি,
- জাতীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ,
- এক বা একাধিক বৃহৎ শক্তি এবং কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি এবং
- সাম্প্রতিক কালের আন্তর্জাতিক বর্ণনাবলীর ইতিহাস এবং অন্যান্য বিষয়ের পটভূমিকায় ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ।
পালমার এবং পারকিনস্ (Palmer and Parkins) বলেছেন যে, উত্তরণশীল বিশ্ব সমাজই হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু। তিনি নিম্নলিখিত বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করতে চান। (১) রাষ্ট্র ব্যবস্থা, (২) জাতীয় ক্ষমতা, (৩) কূটনীতি, (৪) প্রচারকার্য, (৫) জাতীয় নীতি প্রয়োগের অর্থনৈতিক মাধ্যমসমূহ, (৬) সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদ (৭) যুদ্ধ, (৮) শক্তিসাম্য, (৯) আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠন, (১০) যৌথ নিরাপত্তা প্রভৃতি।
কুইনসি রাইট (Quincy Wright) তাঁর ‘The Study of International Relations’ বইটিতে ৮ বিষয়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন। সেগুলি হল—
- আন্তর্জাতিক আইন,
- কূটনীতির ইতিহাস,
- সামরিক বিজ্ঞান বা যুদ্ধের কলাকৌশল,
- আন্তর্জাতিক রাজনীতি,
- আন্তর্জাতিক সংগঠন,
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য,
- ঔপনিবেশিক সরকার এবং
- পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত বিষয়।
বেসরকারী সংস্থা: প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সমাজে একমাত্র কর্মকর্তা নয়। অনেকে বে-সরকারী কর্তার ভূমিকাও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উল্লেখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। বহুজাতিক সংস্থা, ইউরোপীয় কমন মার্কেট, প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংস্থা এবং ন্যাটো (NATO), সিয়াটো (SEATO) প্রভৃতি শক্তি জোট, আরব লীগ, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা, আশিয়ান (ASEAN) প্রভূতি আঞ্চলিক জোট বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের ভূমিকা গ্রহণ করে। তাছাড়া অন্তর্জাতিক সংগঠনও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাবমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। ইউনেস্কো (UNESCO), বিশ্ব শ্রমসংস্থা (I.L.O) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (WHO) কার্যাবলীর সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশের বেসরকারী সংস্থার কার্যাবলী জড়িত থাকে।
জনমত: আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জনমত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছে তা অস্বীকার করা যায় না। শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্ন, নিরস্ত্রীকরণ সমস্যা, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, তথ্য সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিক্ষোভ আলোচনা দানা বাঁধছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (World Trade ORGANISATION—W.T.O.) ভূমিকা নিয়ে গণ-আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের বিষয়ে দেশে দেশে জনমত এক প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা গ্রহণ করছে।
তৃতীয় বিশ্ব: সাম্প্রতিককালে তৃতীয় বিশ্ব (Third World) আন্তর্জাতিক সমাজে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি গোষ্ঠীনিরপেক্ষতা, নিজোট আন্দোলন, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অভ্যন্তরে ও বাইরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করছে।
মূল্যায়ন: যুদ্ধ, শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ প্রভৃতি সমস্যায় শুধু রাষ্ট্র নেতৃত্বের নয়, জনগণের চিন্তা-চেতনায় প্রসারিত হয়ে সক্রিয় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে উদ্যোগী। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা, বেসরকারী সংগঠনের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উপব্যবস্থা আঞ্চলিক জোট, পররাষ্ট্রনীতি, জনমত, ভূ-কেন্দ্রিক রাজনীতি সকল কিছু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শাস্ত্রের বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডী বা সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতন, পুঁজিবাদী দেশগুলির তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নানা কৌশলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিস্তারের অপচেষ্টা, তার বিরুদ্ধে দেশে দেশে গণ আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্যে সক্রিয় উদ্যোগে বিশ্বের এক মেরুকরণ (Unipolar world) সব কিছুই আজ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা ক্ষেত্র। ব্যাপক অর্থে ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠীজীবন, রাষ্ট্রজীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, স্বন্দ্ব-সংঘাত, সহযোগিতা-সমন্বয় সমস্ত কিছুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা জড়িত বলা যায়।