বিশ্বায়ন (Globalization) কোনো নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া বহুপূর্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে প্রয়োগের কাজ শুরু হয়। রোলান্ড রবার্টসনের মতে বিশ্বায়ন এক নয়া-বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) সম্প্রসারণের ধারণার সঙ্গে জড়িত। পুঁজির অবাধ চলাচল, মুক্তবাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ প্রভৃতি ধারণার সকো বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।
বিশ্বায়নের প্রকৃতি [Nature of Globalization]
বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে মূলত যে সমস্ত দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে সেগুলি হল—
(১) অর্থনৈতিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূলভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (I.M.E), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং গ্যাট (General Argeement on Trade and Tariff) চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের দ্রুত প্রসার, লগ্নি পুঁজির অবাধ আদান প্রদান, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন, এক দেশ থেকে অন্য দেশের মধ্যে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, বহুজাতিক বা অতিজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদান প্রদান, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্য মাধ্যমের বিস্তার প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসনে তাঁর “The WTO Agreements on Agriculture and its impact on Developing Countries” শীর্ষক রচনায় বিশ্বায়নের আর্থিক দিকটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন—বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনীতির পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে, তাদের পার্থিব সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের প্রয়োজনে উন্নয়নশীল বিশ্ব তাদের কাঁচামাল জোগান দেওয়ার এবং তাদের অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত সামগ্রী ফেলার কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।
(২) রাজনৈতিক দিক: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্রের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতিরাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে ‘একটি বাজারকেন্দ্রিক সংগঠন’-এ পরিণত করেছে। অবশ্য জাতিরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিলোপসাধন বা বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মকান্ড বিশ্বায়নে দেখা যায় না। অধ্যাপক হলটন তাঁর ‘Globalization and the Nation State’ শীর্ষক রচনায় জাতিরাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন—… জাতিরাষ্টগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে।
জোসেফ এস. নাই এবং জন ডি. জোনাহিউ তাঁদের, ‘Governance as a Globalizing World’ শীর্ষক এক সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন—বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের সচলতা (Mobility of Capital), এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের নির্গমন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে।
(৩) সাংস্কৃতিক দিক: সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য হল সারা বিশ্বে এক সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ইনটারনেটসহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচার শুরু করেছে, এর ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্যাতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এভাবে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এক সংকটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। কে. এম. পানিক্কর তাঁর, ‘বিশ্বায়ন, সংস্কৃতি ও পণ্যায়ন’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংগঠনগুলি বিশেষভাবে সক্রিয়। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে সাংস্কৃতিক আক্রমণ চলেছে সেটি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার এক প্রচেষ্টা। অবশ্য সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে এবং স্বল্পব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
(৪) পরিবেশগত দিক: পরিবেশবিদদের মতে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্বের পরিবেশগত ক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু যে বিনষ্ট করে চলেছে তাই নয়, তাকে পণ্যায়িতও করেছে। পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা তাঁর ‘বিশ্বায়ন ও পরিবেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন—পৃথিবীর মূল সম্পদগুলি হল স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। বিশ্বায়নের প্রভাবে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলি পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ধরনের সম্পদ হিসেবে এই উপাদানগুলি উপজাতি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বিশ্বায়িত কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বায়িত বাণিজ্যের চুক্তিগুলি জাতীয় সংবিধানকে অবনমিত করে, যার অর্থ নাগরিকদের জীবনের প্রতি অধিকার, স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্যের প্রতি অধিকারের অবলুপ্তি।