মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা (Meiji Restoration) জাপানের জাতীয় জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এলেও মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রকৃতি ছিল রক্ষণশীল। জাপানের সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের ফলে টোকুগাওয়া শোগুন শাসনের পতন ঘটেছিল। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পরবর্তী জাপানের নতুন ব্যবস্থা ছিল উদারপন্থী মতাদর্শ থেকে অনেক দূরে। নতুন সংবিধানের মাধ্যমে সম্রাট তথা শাসক শ্রেণীর কর্তৃত্বকে পবিত্র রূপ দেবার প্রয়াস চালানো হয়েছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সম্রাটের প্রতি আনুগত্য হয়ে উঠেছিল মেইজি জাপানের ক্ষমতার উৎস।
জাপানের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যার পরিণতি ছিল জাপানে সামন্ততন্ত্রের অবসান। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের একাংশ আরোও বলেছেন যে, মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘটনা বুর্জোয়া শ্রেণী নিয়ন্ত্রিত হলেও পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরও জাপানের গ্রামাঞ্চলে বহু এলাকায় সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ও বন্ধনগুলি থেকে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও চুক্তি বহির্ভূত নানা বাধা-নিষেধ গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের ওপর নতুন করে আরোপিত হয়েছিল। মেইজি জাপানে সম্রাটতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে চরম কর্তৃত্ববাদ গড়ে উঠেছিল, তা পুঁজিবাদী শোষণের মতোই সামন্ততান্ত্রিক বাধানিষেধকে সুদৃঢ় করেছিল।
মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ঐতিহাসিক ই. এইচ. নরম্যান বলেছেন যে, মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর জাপানের সম্রাট নামতান্ত্রিক শাসক থেকে দেশের প্রকৃত শাসকে পরিণত হন। সেদিক থেকে ঘটনাটি ছিল যথার্থই “পুনঃপ্রতিষ্ঠা” (Restoration)। তাঁর মতে, মেইজি পুনরুদ্ধারের পর জাপানের দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল ও সম্রাট তাঁর হৃত ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলেন। জর্জ স্যানসম বলেছেন যে, ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের পরিবর্তন সামন্ততন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সম্রাটকে পূর্বতন ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু তাঁর মতে এই পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা চলে না, কারণ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঐতিহাসিক ভিনাক রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি মেনে নিতে নারাজ। তাঁর মতে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ঘটনার ফলে সম্রাট প্রত্যক্ষভাবে শাসন ক্ষমতা দখল করেননি। পশ্চিম জাপানের গোষ্ঠীসমূহ অর্থাৎ সাতসুমা, চোসু, তোসা ও হিজেনের নেতৃবৃন্দ দেশের প্রকৃত শাসক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। কুইগাল নামক ঐতিহাসিক বলেন যে, ১৮৬৮ খ্রীঃ সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সম্রাট তাঁর হৃতমর্যাদা এবং আলঙ্কারিক অধিকার ফিরে পান। প্রকৃত ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল না। তাঁর পরামর্শ সভাই প্রায় সকল ক্ষমতা করায়ত্ব করে। ঐতিহাসিক রিচার্ড স্টোরি বলেছেন, টোকিওর নতুন সরকারের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক ছিলেন পশ্চিমী গোষ্ঠীসমূহের নেতারা এবং তাঁরা মুষ্টিমেয় অভিজাতের শাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরবর্তী জাপানকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সাতসুমা গোষ্ঠীভুক্ত সাইগো তাকামোরি ও ওকুবো তোশিমিচি, চোসু গোষ্ঠীভুক্ত কিডো কোইন, ইটো হিরোবুমি ও ইনোউয়ে কাওরু, তোসা গোষ্ঠীভুক্ত ইতাগাকি তাইসুকে এবং হিজেন গোষ্ঠীভুক্ত ওকুমা শিগেনোবু।
ঐতিহাসিক মরিয়াস জ্যানসেন মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কমোডোর পেরির অভিযান থেকে আরম্ভ করে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের সাতসুমা বিদ্রোহ পর্যন্ত জাপানে যা ঘটেছিল, তা ছিল একদিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের আশঙ্কার বিরুদ্ধে জাপানের প্রতিক্রিয়া। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল দ্বিমুখী ক্রিয়াকলাপের অনিবার্য পরিণতি। তাঁর মতে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সাতসুমা বিদ্রোহ পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সর্বশেষ সামুরাই সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া। জ্যানসেন এই সময়টিকে “জাতীয় সুদৃঢ়করণের যুগ” (Age of National Consolidation) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জাতীয়তাবাদী বিপ্লব এবং মেইজি শাসকেরা বহিরাগত বিপদের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসাবে প্রতিরক্ষামূলক আধুনিকীকরণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
জন হ্যালিডে প্রমুখ মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা বলেছেন যে, ১৮৪০-এর দশকের টেম্পো সংস্কার থেকে আরম্ভ করে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের নতুন জাপানী সংবিধান রচিত হওয়া পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে জাপানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তারই অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসাবে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। টোকুগাওয়া শাসনের শেষের দিকে এবং মেইজি শাসনের গোড়ার দিকে জাপানের শিল্পের অগ্রগতিকে উদ্দীপিত করার জন্য অর্থনৈতিক জীবনে কঠোর আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান এই নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করেছিল। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, মেইজি শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক। টোকুগাওয়া সামন্ততন্ত্র থেকে বিংশ শতকীয় পুঁজিবাদে উত্তরণের সেতু হিসাবে উপরোক্ত সময়কালকে (১৮৪০-১৮৮৯) গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ মেইজি নেতারা গ্রহণ করেছিলেন।
তাকাহাসি বলেছেন যে, ইউরোপীয় শক্তিবর্গ কর্তৃক আক্রমণের তীব্র আশঙ্কা মেইজি শাসকদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে তাঁরা কতকগুলি সংস্কার সাধন করেন। এই সংস্কারগুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেছিল। তাকাহাসির মতে, মেইজি নেতাদের পদক্ষেপগুলি ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরোধী একটি রাজনৈতিক বিপ্লব।
মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়ে যে রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছিল, সেই আন্দোলনে কোন সামাজিক শ্রেণী কি ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ঐতিহাসিক হল বলেছেন, যদিও কৃষক ও বণিক শ্রেণী শোগুন-বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন, তবুও এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব ছিল সামুরাই শ্রেণীর হাতে। ঐতিহাসিক ল্যাটুরেট বলেছেন, সম্ভ্রান্ত বা অভিজাত সামুরাইরা নন, নিম্নবর্গীয় সামুরাইরা ১৮৬৭-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের শোগুন-বিরোধী অভ্যুত্থানের গতিসঞ্চার করেছিলেন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে “জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ” (Journal of Asian Studies)-এ লিখিত একটি প্রবন্ধে ঐতিহাসিক অ্যালবার্ট ক্রেইগ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র নিম্নবর্গীয় সামুরাইরাই নন, উচ্চশ্রেণীর সামুরাইদেরও শোগুন-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাছাড়া, জঙ্গী কৃষক বিদ্রোহ, বণিক শ্রেণীর অর্থসাহায্য এবং সাৎসুমা ও চোসু গোষ্ঠীভুক্ত ডাইমিওদের সক্রিয় অংশগ্রহণ শোগুনতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করেছিল। ক্রেইগের মতে বহু শ্রেণীর অংশগ্রহণ মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল।
জন হ্যালিডে বলেছেন, একদল পরিবর্তনকামী সামন্তপ্রভুর সঙ্গে জাপানের বুর্জোয়া শ্রেণীর সমঝোতা মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘটনাটিকে নতুন বিশেষত্ব দিয়েছিল। এই জোট পরিবর্তন-বিরোধী পুরাতনপন্থী সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সময়ে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। পরিবর্তনকামী সামন্তপ্রভু-বুর্জোয়া জোট এই কৃষক বিদ্রোহগুলিকে শোগুন-বিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু মেইজি নেতাদের অর্থনৈতিক নীতি আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, তাঁরা আদৌ কৃষক বিদ্রোহগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না।