শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিহাসের ভূমিকা অপরিসীম। সুশিক্ষা মানুষের আচরণের সার্বিক ও যথাযথ পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্থ চিন্তার একজন মানুষ গড়ে তোলে। মানবসভ্যতার সূচনা, অগ্রগতি ও ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের জ্ঞানভাণ্ডার কীরূপে রয়েছে সেই দিকনির্দেশনা করে ইতিহাস। তাই ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সেই জ্ঞান লাভ করতে পারবে।
পাঠ্যবিষয় হিসাবে আমাদের দেশে ইতিহাসের যাত্রাপথ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। এই দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ দুশো বছর নানা বাগ্বিতণ্ডার মধ্য দিয়ে এদেশে ইতিহাস স্কুলের পাঠক্রমেকে নিজের স্থান করে নিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ইতিহাস আপন মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
ইতিহাসের মূল্য আজ নির্ণীত হয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে। যেমন—(১) মনস্তাত্ত্বিক দিক, (২) সমাজতাত্ত্বিক দিক ও (৩) শিক্ষা সম্বন্ধীয় দিক।
মনস্তাত্ত্বিক দিক (Psychological Aspect)
পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত প্রতিটি বিষয়ের দুটি দিক আছে—একটি হল দার্শনিক দিক, আর একটি হল মনস্তাত্ত্বিক দিক। বর্তমানকালে শিক্ষাক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক দিকের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(১) অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি: ইতিহাস রচিত হয়েছে মানুষের সীমাহীন অনুসন্ধিৎসার ফলে। অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষের চিরদিনের। ইতিহাস শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি করে, অনুসন্ধিৎসাকে চরিতার্থ করতে সাহায্য করে, শিক্ষার্থীকে সত্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত করে।
(২) কল্পনা বিলাস তৃপ্ত করার প্রয়োজনীয়তা: বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের কৌতূহল থাকে। এ সময় মানুষের মন কল্পনার পাখায় ভর করে দেশ থেকে দেশান্তরে উড়ে যায়। এই কল্পনা বিলাসকে তৃপ্ত করার প্রয়োজনীয়তা মনস্তত্ত্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে ইতিহাস।
(৩) সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব বিকাশ: ইতিহাস একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক সুশৃঙ্খল পদ্ধতি অনুসরণ করে। ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর একটি সুস্থ ও সুশৃঙ্খল মানসিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীর সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে এই মানসিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
(৪) ঔদার্যবোধ সৃষ্টি: ইতিহাসের অন্দরমহলে নিত্য ধ্বনিত হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের মানুষে মানুষে মহামিলনের ঐকতান। এই ঐকতান ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করে, আন্তর্জাতিক সংবেদনশীলতায় জারিত করে। সংকীর্ণ জাতীয় চেতনা এবং আত্মদ্বন্দ তুচ্ছ করে শিক্ষার্থী উন্নত শিরে আলোকের দিশায় অগ্রসর হতে উদ্দীপিত হয়। ইতিহাস শিক্ষার্থীর অন্তরে জন্ম নেয় অপরূপ পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন সে পূরণ করে তার ঔদার্যবোধ থেকে। ইতিহাস পাঠের একটি অন্যতম মূল্য হল ঔদার্যের শিক্ষা, সংকীর্ণতা পরিহারের শিক্ষা। দেশ, জাতি ও সমাজের ঊর্ধ্বে আছে শিক্ষার্থীকে উদার নীতিতে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা, দয়া, দাক্ষিণ্য প্রভৃতি মানসিক গুণগুলির বিকাশ সাধনে যত্নবান হতে হবে।
সমাজতাত্ত্বিক দিক (Sociological Aspect)
পূর্বে ইতিহাস বলতে বোঝাত রাজা, রাজবংশের ও যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি। ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরিবর্তন এল। বর্তমানে ইতিহাস হল মানুষ ও তার সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার সুচারু বিশ্লেষণ। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থী যেসব সামাজিক চেতনা অর্জন করবে সেগুলি হল—
(১) ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সমাজ বিবর্তন সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
(২) ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে মানুষের সভ্যতা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশ বা জাতির সৃষ্টি নয়।
(৩) বর্তমানের ঘটনাবলিকে সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে হলে সেই ঘটনাবলির পশ্চাৎপটকে ভালোভাবে জানতে হবে।
(৪) বর্তমানের সঠিক বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট কার্যধারা গ্রহণ করতে ইতিহাস সাহায্য করে। ইতিহাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে অগ্রগামী দৃষ্টিভঙ্গি (Forward look) বা ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে।
(৫) ইতিহাসের নূতন ব্যঞ্জনা হল মানুষ ও তার অগ্রগতি এবং সমাজজীবন। তার কারণ বর্তমানের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নাগরিকদের সমাজ সচেতন করে তুলতে হবে। বর্তমানের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নাগরিক। তাদেরকে সমাজ সচেতন করে তুলতে ইতিহাস যথেষ্ট সাহায্য করে। ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়।
(৬) শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনে দেশের মানবসম্পদ (Man power)। অথচ বর্তমানে যে প্রেমে গভীর হতাশাবোধ তরুণসমাজকে এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রধান কারণ হল আমাদের সামাজিক মূল্যহীনতা। তাই এই মুহূর্তে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ইতিহাস এ বিষয়ে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষা সম্বন্ধীয় দিক (Pedagogical Aspect)
বিদ্যালয় পাঠক্রমে ইতিহাসের শিক্ষাগত মূল্যও অপরিসীম। যেমন—
(১) শিক্ষার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে সাহায্য করা। ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন হয়, ইতিহাস শিক্ষার্থীর নীতিবোধ গঠনে সাহায্য করে।
(৩) ইতিহাস হল মানব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের জ্ঞানভান্ডার। শিক্ষার্থী ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় জানতে সমর্থ হবে।
(৪) যে-কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ শিক্ষার্থীর মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা প্রতিফলিত করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা। ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা যায়।
(৫) ইতিহাসের অনেক তথ্য বিতর্কমূলক থাকে ও সংশয়ের অবকাশ থাকে। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রয়োগ সাধন ঘটাতে হবে। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে অর্জিত চিন্তা, যুক্তি ও বিচার শক্তির উন্নতি ও বিকাশ সাধনের ফলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বাস্তব জীবনে পদে পদে অনুভূত হয়, জীবনে চলার পথে তার অবশ্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
(৬) শিক্ষার্থীর কৈশোরে যে আবেগজনিত অস্থিরতা প্রায়শ বিপদ-বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে তার ভারসাম্য সাধনের ক্ষেত্রে ইতিহাসের এই বৌদ্ধিক মূল্য মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
উপসংহারে বলা যায় যে, আধুনিককালে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিহাস চর্চার কথা সর্বজনস্বীকৃত। শিক্ষা পরিকল্পনায় ইতিহাস আজ উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে।