ঐতিহাসিক রবার্ট পামারের মত অনুসারে ফরাসি বিপ্লবকে ইউরোপের বিপ্লব বলাই সঙ্গত। আসলে ফরাসি বিপ্লব ছিল ইউরোপের ক্ষয়প্রাপ্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পতনের স্বাক্ষর। ফরাসি বিপ্লবের সূচনা অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যেই নিহিত ছিল।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজ্য বিস্তারকে জাতির শক্তি ও মর্যাদার চিহ্ন বলে ধরা হত। রাজা স্বর্গীয় অধিকার নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি কাজের জন্যে একমাত্র ঈশ্বরের নিকট দায়ী। পার্থিব কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী চলবেন না। স্বর্গীয় অধিকার মতবাদের আশ্রয় নিয়ে রাজারা স্বৈরাচারী হন। ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ ছিল রাজকীয় স্বৈরাচারী ক্ষমতার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। রাজা চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন, “রাজাই হলেন রাষ্ট্র”। ইউরোপের জনসাধারণের বা প্রজাদের স্বাধীনতা বলে কিছুই ছিল না। অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্থ ও অত্যাচারী। জনসাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার ছিল না। রাজা, অভিজাত ও ধর্মযাজকরা একযোগে জনসাধারণকে শাসন করত। ন্যায়বিচার বা আইনের শাসন ছিল না।
অষ্টাদশ শতকের রাজকুল “আলোকপ্রাপ্ত স্বৈরাচারী” (Enlightened Despot) মতবাদে বিশ্বাস করতেন। অষ্টাদশ শতকের আলোকিত চিন্তা (Enlightened Thought) বা বুদ্ধিবিভাসিত দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাজারা বহু শাসন ও অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেন। ঐতিহাসিক লর্ড এ্যাক্টন স্বৈরাচারী রাজাদের এই সংস্কার নীতিকে “রাজতন্ত্রের অনুতাপ’ (Repentance of the monarchy) বলে অভিহিত করেছেন। প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক দি গ্রেট, রাশিয়ার জারিনা ক্যাথারিন, অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় যোসেফ প্রভৃতি ছিলেন আলোকিত রাজতন্ত্রবাদের মুখ্য প্রবক্তা। তাঁরা রাজ কর্তব্যের আদর্শে উদ্দীপিত হয়ে নানাবিধ সংস্কার প্রবর্তন করেন। কিন্তু ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজারা আলোকিত দর্শনের আদর্শে প্রভাবিত হননি। তাঁরা কেবলমাত্র স্বর্গীয় অধিকারে বিশ্বাস করতেন। আলোকিত শাসকদের মধ্যে স্পেনের তৃতীয় চার্লস, পর্তুগালের প্রথম যোসেফ, সুইডেনের তৃতীয় গাষ্টাভাস, সার্ডিনিয়ার তৃতীয় ইম্যানুয়েল প্রভৃতি। আলোকিত মতবাদের অনুরাগী মন্ত্রীদের মধ্যে ফ্রান্সের চোইসুল ও তুর্গো, ইতালীর তানুচ্চি প্রভৃতি।
পুরাতন ক্ষয়প্রাপ্ত সমাজ ব্যবস্থাকে বদলিয়ে নতুন আলোকিত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোন চেষ্টা আলোকিত রাজারা করেননি। প্রজাদের প্রতিনিধি সভা গঠন বা উদারতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন অথবা প্রজাদের মতামত স্বীকার করে শাসন পরিচালনা প্রভৃতি কর্তব্য তাঁরা অগ্রাহ্য করেন। প্রজাদের কোন নায্য দাবী তাঁরা স্বীকার করতেন না। লফেভারের মত, কেন্দ্রীভূত শাসন, দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ ও সংরক্ষণ-পন্থী অর্থনীতির মাধ্যমে আলোকিত রাজারা নিজেদের ক্ষমতাকে দৃঢ় করেন। আলোকিত শাসন ছিল আসলে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে স্থায়ী ও জনপ্রিয় করার একটি উপায় মাত্র।
আলোকিত শাসন ব্যবস্থায় আলো অপেক্ষা স্বৈরাচারের ভাগ ছিল অনেক বেশী। অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় যোসেফ ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রম। প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ও রাশিয়ার রাণী ক্যাথারিন প্রভৃতি তৃতীয় শ্রেণী বা সাধারণ লোকের উন্নতি বিধানের কোন চেষ্টা করেননি। তাঁরা অভিজাতদের শাসন ক্ষমতার অংশীদার করেন। আলোকিত স্বৈরতন্ত্রের সফলতা, রাজার বাক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল ছিল। আলোকিত রাজার মৃত্যুর পর উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার প্রচলিত সংস্কার লোপ পেত। সুতরাং আলোকিত স্বৈরতন্ত্রের দ্বারা ইউরোপে শাসন বা সমাজ ব্যবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সামন্ত প্রথা, ভূমিদাস প্রথা প্রভৃতি সামাজিক অন্যায়ের কোন প্রতিকার আলোকিত শাসন ব্যবস্থার দ্বারা হয়নি।
আলোকিত স্বৈরতন্ত্রের যুগে ইউরোপের রাজারা প্রতিনিধি সভা প্রবর্তন করেননি। ফ্রান্সে ১৬১৪ খ্রীঃ থেকে জাতীয় সভা বা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়। বিচারসভা রাজাদের হাতের ক্রীড়নক ছিল। ফ্রেডারিক দি গ্রেট প্রভৃতি রাজা আলোকিত দর্শনের অনুরাগী হলেও মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রকে ভাঙার জন্যে কোন চেষ্টা করেনি।