পরবর্তী-বৈদিক যুগে আর্যদের রাজনৈতিক জীবনে (Political life of Aryans) সুদূরপ্রসারী ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। এই যুগে আর্যরা উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এর ফলে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা বা মধ্যদেশ আর্য সভ্যতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের স্থলে পরবর্তী বৈদিক যুগে বৃহৎ বৃহৎ রাজ্যের উৎপত্তি পরিলক্ষিত হয়। পুরোনো উপজাতি গোষ্ঠীগুলি ভেঙে নতুনভাবে সংমিশ্রিত হয়ে নতুনতর আর্যগোষ্ঠী বা উপজাতি গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভরত ও পুরুর মিলনে কুরু উপজাতি এবং তুর্বস ও কিরভির মিলনে সৃষ্টি হয় পাঞ্চাল উপজাতি। পরবর্তী বৈদিক যুগে কাশী, কোশল, বিদেহ, বৎস, মথুরা, কুরু, পাঞ্চাল প্রভৃতি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং বৃহৎ রাজ্যের উন্মেষ হতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাজারা অশ্বমেধ, রাজসুয়, বাজপেয় প্রভৃতি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে থাকেন এবং সম্রাট, বিরাট, স্বরাট, ভোজ, সার্বভৌম, একরাটা, বিশ্বজনীন প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতে থাকেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং দৈবস্বত্বের দাবি করতে থাকেন। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে, রাজা হলেন প্রজাপতি বা ব্রহ্মার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজাকে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, যম, বায়ু প্রভৃতি দেবতার শক্তিতে বলবান বলা হত। ব্রাহ্মণ ছাড়া সবার উপর রাজার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি ইচ্ছামতো মানুষের উপর অত্যাচার করতে পারতেন এবং শূদ্রকে হত্যা করতে পারতেন। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে, রাজা হলেন অভ্রান্ত ও সকল শাস্তির উর্ধ্বে।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সভা ও সমিতি বিদ্যমান ছিল। রাজাকে বিভিন্ন কাজে সভা ও সমিতির অনুমোদন নিতে হত। অথর্ব বেদে নির্বাচিত রাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে, কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সভা ও সমিতি তাদের পূর্বগৌরব বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে।
ডঃ কোশাম্বী মনে করেন যে, পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজা স্বৈরাচারী ছিলেন না। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজন্যবর্গের নিয়োগের প্রথা তখনও কিছুটা প্রচলিত ছিল। রাজপদ তখনও সম্পূর্ণ বংশানুক্রমিক না হওয়ায় জনগণের মতামতের দাম ছিল এবং জনগণ স্বৈরাচারী রাজাকে বিতাড়িত করতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, সৃঞ্জয় উপজাতি তাদের অত্যাচারী রাজা দৃষ্টঋতুকে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। সিংহাসন হারানোর ভয় রাজাকে স্বৈরাচারী হতে দিত না। সিংহাসন লাভের পূর্বে রাজাকে অঙ্গীকার করতে হত যে, তিনি প্রজাপালন ও রাজ্যের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করবেন। ব্রাহ্মণরা রাজার ‘অভিষেক’ সম্পাদন করত। সভা ও সমিতিকে একেবারে উপেক্ষা করা রাজার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ‘ধর্মন বা পবিত্র বিধান অনুসারে রাজাকে দেশ শাসন করতে হত। যদিও পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজক্ষমতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসনকার্যে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে কর্মচারীদের নতুন পদের সৃষ্টি করা হয়। সেগুলি হল— সংগ্রহিত্রী (কোষাধ্যক্ষ), ভাগদুখ (কর আদায়কারী), সূত (রাজকীয় ঘোষক), ক্ষত্রী (রাজসংসারের সরকার), অক্ষবাপ (জুয়াখেলার অধ্যক্ষ), গো-বিকর্তন (শিকারে রাজসঙ্গী) ইত্যাদি। স্থপতি ছিলেন সীমান্ত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী। শতপতি ছিলেন একশোটি গ্রামের ভারপ্রাপ্ত। প্রামণী ছিলেন সর্বশেষ স্তর বা গ্রামের প্রধান।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সংগ্রহিত্রী ও ভাগদুখ নামে রাজস্ব আদায়ের জন্য দু’জন কর্মচারী নিযুক্ত হয় এবং ‘বলি’ ও ‘শুল্ক’ দু’ধরনের রাজস্ব আদায় করা হত।
পরবর্তী বৈদিক যুগে বিচার ব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা—যদিও তিনি সর্বদা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন না। বিচারের দায়িত্ব ছিল অধ্যক্ষের উপর। অনেক সময় মুষ্টিমেয় সভাসদদের দ্বারা গঠিত ক্ষুদ্র সমিতি বিচার করত। গ্রামের ছোটোখাটো বিচার করত গ্রাম্যবাদীন (গ্রাম্যবিচারক) ও তাঁর সভা। অনেক সময় অপরাধীকে জল ও আগুনের মধ্য দিয়ে যেতে হত। দেওয়ানি মামলা সাধারণত সালিশির মাধ্যমে মেটানো হত।