গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় তার ধ্যান ধারণা বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন সবমতাবলম্বী একদল মানুষের সহযোগিতা। সুতরাং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। ভারত, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশের মতো সুইজারল্যন্ডেও রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু সুইস দলপ্রথার সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের দলপ্রথার পার্থক্য রয়েছে। জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও সুইজারল্যান্ডে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপক রূপ ধারণ করে নি, রাষ্ট্রতরণীও দলীয় রাষ্ট্রনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে বিশৃঙ্খলার পথে যাত্রা করে নি। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুইস শাসন ব্যবস্থায় দ্বি-দল প্রথা গড়ে ওঠে নি, বহু রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়েছে।
রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মসূচী
(১) প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল: প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল হল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (The Progressive or Radical Democratic Party)। সমাজ জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার উদারনৈতিক দলের স্বাচ্ছন্দ্য নীতি (laissez faire) অসার প্রমাণিত হয়। সেই সময় উদারনৈতিক দলের প্রগতিশীল সদস্যগণ নূতন প্রগতিশীল দল গঠন করেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই দলের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আদর্শের দিক থেকে প্রগতিশীল দল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রাধান্য সমর্থন করে। তা ছাড়া রেলপথ জাতীয়করণ, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার, যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নে গণ-উদ্যোগ প্রভৃতি নীতির সমর্থন করে থাকে। পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে এই দল নিরপেক্ষতা নীতির সমর্থক।
(২) ক্যাথলিক রক্ষণশীল দল: সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দল হল ক্যাথলিক রক্ষণশীল দল (Catholic Conservative Party)। যে সকল ক্যান্টন ও নাগরিকগণ ১৮৪৮ সালে রাষ্ট্র-সমবায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তারাই ক্যাথলিক রক্ষণশীল দল গঠন করে। এই দল ক্যান্টনীয় স্বাতন্ত্র্যের উগ্র সমর্থক এবং কেন্দ্রীয় প্রাধান্যের তীব্র বিরোধী। ক্যাথলিক রক্ষণশীল দলের মূল দাবী হল দুটি-ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন রক্ষা। ১৮৯১ সালে প্রগতিশীল দলের সহযোগিতায় ক্যাথলিক রক্ষণশীল দল সম্মিলিত সরকার গঠন করে। বর্তমানে দলের প্রভাব কমে গেলেও রাজ্য পরিষদে এই দলের শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি।
(৩) সমাজবাদী-গণতান্ত্রিক দল: সুইজারল্যান্ডের অপর একটি বৃহত্তম দল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল (The Social Democratic Party) ১৮৯০ সালে গঠিত হয়। প্রথম অবস্থায় এই দল শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণ, উৎপাদন ও বণ্টনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিপ্লবের সমর্থক ছিল। কিন্তু ক্রমশ সামাজবাদী দল গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে কাম্য পরিবর্তনের নীতিকে স্বীকার করে নিয়েছে। বর্তমানে এই দল শ্রমিক কল্যাণকেই প্রধান বলে গ্রহণ করে মজুরী বৃদ্ধি, বেকার ভাতা, কর্মের অধিকার প্রভৃতি সমর্থন করে। শ্রমিকের স্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে এই দল সুইস জনগণের কাছে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
(৪) কৃষিজীবীদের দল: প্রগতিশীল দলের কিছু সদস্য ১৯১৮ সালে মূল দল থেকে বাইরে এসে কৃষক, ক্ষুদ্র শিল্পী ও মধ্যবিত্তের দল (The Agrarians, Artisans and Middle Class Party) গঠন করে। এটি সংক্ষেপে কৃষিজীবীদের দল (The Farmers’ Party) নামে অভিহিত হয়। এই দলের মূল সমর্থক হল কৃষিজীবী মানুষ। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ-সাহায্য, জাতীয় প্রতিরক্ষার সুষ্ঠুব্যবস্থা, কৃষিপণ্যের দাম স্থিরীকরণ এবং জাতীয় স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধি প্রভৃতি নীতি সমর্থন করে। কিন্তু এই দলকে প্রগতিশীল দল অপেক্ষা রক্ষণশীল (more conservative than the Redicals) বলা যেতে পারে।
(৫) অন্যান্য দল: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়া সুইজারল্যান্ডে অন্যান্য দলও রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল (The Liberal Democratic Party)। এটি সুইজারল্যান্ডের প্রাচীনতম দল। স্বাচ্ছন্দ্য নীতি (Laissez Faire) এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রসারই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। বর্তমান রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে উদারনৈতিক দলের প্রভাব বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না। অন্যান্য ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলি হল সাম্যবাদী দল (যা বর্তমানে শ্রমিক দল বা Labour Party নামে পরিচিত), স্বতন্ত্র দল (Independents), যুব-কৃষক দল (Young Farmers), গণতন্ত্রী দল (Democratic Party), জাতীয় ফ্রন্ট (The National Front) প্রভৃতি।
সুইজারল্যান্ড দলপ্রথার বৈশিষ্ট্য
সুইজারল্যান্ডে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সুইস দলপ্রথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন অপেক্ষা ফ্রান্সের সঙ্গে অধিক তুলনীয়। স্বাভাবিক কারণেই সুইজারল্যান্ডে বহুদলের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে।
প্রথমত, সুইস দলপ্রথার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল এর কেন্দ্রীয় সংগঠনের অসংহতি। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে দলের কেন্দ্রীয় সংস্থার প্রভাব দলের ওপর খুবই স্পষ্ট। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে দলীয় নিয়মানুবর্তিতার কঠিন শাসন নেই; দলনেতাগণের প্রভুত্বের চাপও নেই। ক্যান্টন বা স্থানীয় নেতৃবৃন্দই যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন।
দ্বিতীয়ত, সুইজারল্যান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভাগ-বাঁটোয়ারা পদ্ধতির (spoils system) প্রবর্তন হয় নি। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়, দলীয় স্বার্থের কারণে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয় না।
তৃতীয়ত, সুইস দলপ্রথার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পরিষদের দলনিরপেক্ষতা এবং স্থায়িত্ব। দল নিরপেক্ষতার জন্য পরিষদীয় নির্বাচনে কোন দেশই উৎসাহ প্রদর্শন করে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যগণ পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন, ফলে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাবই দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা ভারতের মতো সুইজারল্যান্ডের নির্বাচনে কোন বিখ্যাত দলনেতার পরাজয়ে বিরোধী দলের শিবিরে আনন্দের বন্যা বয় না।
চতুর্থত, গণভোট পদ্ধতির জন্যও দলীয় ব্যবস্থা দৃঢ়বদ্ধ হয়ে উঠতে পারে না। সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন হয় বলে আইনসভার বিশেষ গুরুত্ব থাকে না।
পঞ্চমত, সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতির ধারাবাহিকতা এবং নিরপেক্ষতা দলীয় বিচার এবং দলীয় সংঘর্ষের সম্ভাবনার পথে প্রতিবন্ধক হয়েছে।
ষষ্ঠত, বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে দলগুলির সুইস জনগণ ঐতিহাপরস্পরায় রাষ্ট্রনীতি নিয়ে ব্যবসাকে ঘৃণা করে; তারা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রলোভনে জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে না। তা ছাড়া আইনসভার অধিবেশন মাত্র ১০/১২ সপ্তাহের জন্য অনুষ্ঠিত হওয়ায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা, বা তর্ক-বিতর্কের সুযোগ সুইস আইনসভায় খুবই কম।
সপ্তমত, সুইজারল্যান্ডের ক্যান্টনগুলিতে প্রকৃত স্বায়ত্ত্বশাসন গড়ে উঠায় একদিকে দেশপ্রেম জাগরিত হয়েছে, অপরদিকে দক্ষ ও উন্নত শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ফলে দলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা সমালোচনার সুযোগ কম।
অষ্টমত, দেশের অর্থব্যবস্থাও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুকূল নয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য তীব্র দলীয় মনোভাব সৃষ্টির সহায়ক। সুইজারল্যান্ডে সকল নাগরিকই খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের অভাব থেকে মুক্ত। এখানে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বিশেষ ব্যাপক নয়, ফলে শ্রেণী সংঘর্ষও তীব্র রূপ ধারণ করতে পারে নি।
পরিশেষে বলা যায় যে, সুইস জাতীয় চরিত্রও দলীয় প্রভাবকে প্রশমিত করেছে। সুইজারল্যান্ডের শিক্ষিত, সচেতন জনমানসে নেতৃত্বের প্রতি স্বাভাবিক বিতৃষ্ণা রয়েছে। সুইস জনগণ রাষ্ট্রনেতা চায় না। তারা চায় সেবক। এই কারণে সুইজারল্যান্ডের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে গ্ল্যাডস্টোন, চার্চিল, রুজভেল্ট, আইসেনহাওয়ার এবং নাসেরের মতো নেতার আবির্ভাব হয় না। যারা নীরবে দেশের সেবা করে বিস্তৃতির অতলে ডুবে যান সেই সকল সেবাব্রতী মানুষই সুইজারলান্ডের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন।