খ্রিস্টধর্মে নারীদের অবস্থান তথা ভূমিকা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। অনেকের মতে বাইবেলে খ্রিস্টান নারীদের মর্যাদা স্বীকৃত। অনেক ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম মহিলাদের অসামান্য অবদানের কথা বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক যুগে অনেক নারী ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে একটি নূতন দৃষ্টিকোণ থেকে খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্রকে পাঠ করেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, শাস্ত্র যেখানে নারীদের মর্যাদা দিয়েছে, খুব সুপরিকল্পিতভাবে কিছু স্বার্থান্বেষী পুরুষ, গীর্জার পঠন পাঠন থেকে শাস্ত্রের সেই অংশগুলি কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
বিশিষ্ট খ্রিস্টধর্মের গবেষক King (1998) মন্তব্য করেছেন যে, New Testament পাঠ করলে বোঝা যায় যে যীশু খ্রিস্টের একেবারে আদি ভক্তদের মধ্যে অনেকে ছিলেন মহিলা। মহিলারা যীশুকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মেরী ম্যাগডালিন, জোয়ানা, এবং সুজানা।
যীশু যেখানে গমন করেছেন, মহিলাদের দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে এবং বৃহত্তর সামাজিক পটভূমিতে, নারী সমাজের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল। এমনকি মৃত্যুর পর তিনি নারী সমাজে সম্মান অর্জন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টির প্রথম শতকে মহিলাদের অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে মহিলারা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। Stark তাঁর গবেষণায় (1996) দেখিয়েছেন যে, খ্রিস্টধর্ম ঘটনা পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে অধিকতর ছিল। অনেক নারী তাদের স্বামী বা ভ্রাতার সঙ্গে স্থানান্তরে গমন করে মিশনারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই সমস্ত মহিলাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। নানা অত্যাচার করা হয়েছিল, কখনো হত্যাও করা হয়। যীশু সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে জ্ঞান দিতে গিয়ে কখনো কখনো তাঁরা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
যীশুর প্রধান বারজন অনুগামীর মধ্য অন্যতম ছিলেন পল। তিনি খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের মাঝামাঝি কিছু পত্রে উল্লেখ করেছেন যে খ্রিস্টধর্মের আদি পর্বে মহিলাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এমনকি গীর্জা স্থাপনের পেছনে তাঁদের অবদান আছে। রোমান দুনিয়ায় খ্রিস্টধর্ম অনুমোদন পায়নি। নিউ টেষ্টামেন্টে এমন অনেক উদাহরণ আছে যে মহিলাগণ প্রার্থনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, deaconess (যাজকের নীচের পদ) এবং ধর্মান্তরকরণে প্রয়াসী ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতাদানের ক্ষেত্রে মহিলাদের এগিয়ে আসতে দেখা গেছে যদিও এই সমস্ত কাজ করার ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য অনুমোদন ছিলনা।
খ্রিস্টধর্মে আদিপর্বে এবং মধ্যযুগে খ্রিস্টান নারীদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হলেও, বর্তমানে খ্রিস্টধর্মে মহিলাদের ভূমিকা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আধুনিক যুগে অত্যাচারিত হতে হয় না। তবে আজকাল দেখা যাচ্ছে যে, ভারতে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে। আজকাল গীর্জা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এমনকি তাঁরা প্যাস্টর (Pastors) এবং চ্যাপলেইন (Chaplain) পদ অলংকৃত করছেন। কেউ কেউ একে গত কয়েক দশকের নারীবাদী (feminist) আন্দোলনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন।
অনেকের মতে খ্রিস্টধর্মের সমাজে নারীদের উপর পুরুষের প্রভুত্বকে ত্বরান্বিত করে। অনেক আধুনিক নারী মনে করেন যে গতানুগতিক সমাজে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। তাঁদের সম্বন্ধে পুরুষদের গতানুগতিক তথ্য অযৌক্তিক কিছু ধারণা তাদের সমাজে একটি প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। অযৌক্তিক ধারণার বশবর্তী পুরুষ সমাজ মহিলাদের আশা আকাঙ্খা বা সমস্যা, সম্ভাবনা ও ক্ষমতাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। Doug Groothuis মনে করেন যে খ্রিস্টানদের এই ধরনের অভিযোগ সম্বন্ধে সংবেদনশীল হওয়া উচিৎ। তাঁর মতে ঈশ্বর সকলকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতে শেখান (Genesis 1:28) তা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেক অ-খ্রিস্টান নারীবাদী অভিযোগ করেন যে বাইবেলে ঈশ্বর হল পুরুষ এবং সেক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে ঈশ্বরের অধিকতর সাদৃশ্য থাকবে। অর্থাৎ ঈশ্বর যেভাবে তাঁর সৃষ্টির উপর কর্তৃত্ব জাহির করেন, পুরুষ মানুষ সেইভাবে নারীদের উপর নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। এই সমস্ত অভিযোগ খণ্ডনে উদ্যোগী Doug ধর্মশাস্ত্র ব্যাথা করে বলেছেন যে বাইবেলের ঈশ্বর কোনভাবে পুরুষ নন। এই ঈশ্বরের কোন লিঙ্গ নেই (John 4:24)।
Doug Groothuis বলছেন, যে ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাইবেল আবির্ভূত হয়েছিল সেখানে নারীদের তুলনায় পুরুষের কর্তৃত্ব অধিক ছিল। তবে তার অর্থ এই নয় যে বাইবেল নারীর উপরে পুরুষের কর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে চেয়েছিল। যীশু কখন একটা পুরুষ শাসিত সমাজের কথা ভাবেননি। তাঁর অনুগামীদের অবাক করে দিয়ে যীশু মহিলাদের ধর্মশাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন (Luke 10: 38-42 )। নিজের নবজাগরণের (resurrection) পরে যীশু আবির্ভূত হয়েছিলেন মেরীর সম্মুখে এবং জগৎ পরিবর্তনের যে ঘটনা যীশু ঘটাচ্ছিলেন তাঁর সাক্ষী রেখেছিলেন মেরীকে। এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা কারা সেই যুগে মহিলাদের সাক্ষ্য দানের মর্যাদা দেওয়া হতো না (John 20 : 17-18; Matthew 28 : 5-10, Doug)।
Doug Groothuis আলোচনা করেছেন যে যীশুর গুরুত্ব তার পৌরুষের জন্য নন, তাঁর সামাজিক গুরুত্ব নিহিত আছে তাঁর পবিত্র মানবতার মধ্যে এবং সমগ্র মানব জাতির সঙ্গে নিজেকে এক করে ভাবার ক্ষমতার মধ্যে।
নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মাদার টেরেসা কলকাতাকে কেন্দ্র করে তাঁর সমাজ সেবামূলক কার্যকলাপ বজায় রেখেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বহু দুস্থ তথা নিরাশ্রয় শিশুর আশ্রয়। অনাথ শিশুদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে যারা এনেছিলেন তাঁরা মাদারের সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি বা চাননি। ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র দেশে, যেখানে শিক্ষার আলো সর্বত্র পৌঁছায়নি সেখানে বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবাপ্রতিষ্ঠানে বহু খ্রিস্টান মিশনারী মহিলা শিক্ষা ও সেবার মাধ্যমে সমাজে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুমিত সরকার, তনিকা সরকার প্রমুখ তাঁদের “Christian comversions” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে আমাদের দেশের অনেক সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় মিশনারীদের দ্বারা। অনেক প্রথম সারির বালিকা বিদ্যালয় পরিচালিত হয়ে থাকে মিশনারী মহিলাদের দ্বারা। সুমিত সরকার যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে সমস্ত খ্রিস্টান সমাজসেবীদের ধর্মান্তরকরণের অধিকার থাকে না। যেমন কয়েক বছর আগে ওড়িষ্যায় ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ অস্ট্রেলীয় সমাজসেবীকে এক ধর্মীয় হিন্দুত্ববাদী পুড়িয়ে মেরেছিল, তাঁর ধর্মান্তরকরণের অধিকার ছিল না। তাঁর দোষ ছিল যে তিনি কুষ্ঠরোগীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ভারতের গ্রামাঞ্চলে আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে এবং দরিদ্র বঞ্চিত অন্যান্য মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য চেতনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।