মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন রাষ্ট্রপতি। তত্ত্বগত ও কার্যক্ষেত্রে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির হাতে শাসনের সকল ক্ষমতা ন্যস্ত। নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা ও ক্ষমতা অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কগণের ক্ষমতার তুলনায় অভিনব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী [Powers and Functions of the USA President]
সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যতীত বিচার বিভাগীয় রায়, কংগ্রেস প্রণীত আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপক ক্ষমতা দান করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত— (১) শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা, (২) আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা ও (৩) বিচার- সংক্রান্ত ক্ষমতা।
(১) শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা: আমেরিকার রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র কংগ্রেস-প্রণীত আইন, অন্য রাষ্ট্রের সহিত চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়ের রায় ও নির্দেশ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর করাই রাষ্ট্রপতির কর্তব্য। তিনি সিনেট সভার অনুমোদন গ্রহণ করে শাসন বিভাগীয় কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারকগণকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। শাসন বিভাগের কোন কর্মচারীকে পদচ্যুত করবার জন্য রাষ্ট্রপতিকে সিনেট সভার অনুমোদন নিতে হয় না। রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি দেশের সকল সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। এই ক্ষমতার ব্যবহার করে তিনি বিদেশে সৈন্য পাঠাতে পারেন এবং দেশে বিভিন্ন সময়ে বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ (Habeas Corpus) স্থগিত রাখতে পারেন।
বৈদেশিক ব্যাপার পরিচালনার সম্পূর্ণ ভার রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত। তিনি সিনেট সভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের চূড়ান্ত অনুমোদনক্রমে যেকোনো সন্ধি স্বাক্ষর করতে পারেন। যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা কংগ্রেসের ওপর ন্যস্ত কিন্তু রাষ্ট্রপতি পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনার ক্ষমতার মাধ্যমে এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে পারেন যাতে যুদ্ধ ঘোষণা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে সম্মতি দিতে হয়। বর্তমানে যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে, ঠাণ্ডা লড়াই-এর পরিবেশে, পুঁজিবাদের তীব্র সংকটের সময়ে এবং দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য মার্কিন দেশে রাষ্ট্রপতির হাতে বিশেষ ক্ষমতা অর্পণ স্বাভাবিকভাবে দেখা দিয়েছে।
(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতির আইন-বিষয়ক কোন ক্ষমতা নেই।
প্রথমত, রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সদস্য নন। তিনি কোন কক্ষকে ভেঙ্গে দিতে পারেন না। তিনি উদ্যোগী হয়ে কংগ্রেসের কোন কক্ষে বিল উত্থাপন করতে পারেন না। কার্যক্ষেত্রে প্রথা ও রীতিনীতির উদ্ভবের ফলে রাষ্ট্রপতি আইন বিষয়ে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। রাষ্ট্রপতি দলীয় সমর্থনে নির্বাচিত হন এবং আইনসভায় তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তিনি প্রয়োজনমত আইন প্রণয়ন করাতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি বিশেষ বিশেষ সময়ে কংগ্রেসকে দেশের অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ জ্ঞাপন করতে বাধ্য। সংবাদ জ্ঞাপনের সময় তিনি প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে পারেন। কংগ্রেসের পক্ষে আইন প্রণয়নের সময়ে ঐ সকল সুপারিশ উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রপতি সংবাদপত্রের নিকট দেশের অবস্থা ও শাসন পরিচালনা সম্বন্ধে নিজ অভিমত জানাতে পারেন। জনসমর্থন হারাবার ভয়ে কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নির্দেশ উপেক্ষা করতে সাহসী হয়না। রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। কংগ্রেসের কোন একটি কক্ষে রাষ্ট্রপতির সমর্থনে এক তৃতীয়াংশের কিছু অধিক সদস্য থাকলে বিল কখনো আইনে পরিণত হতে পারবে না। তাই কার্যত রাষ্ট্রপতির আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ভূমিকা প্রধান ভূমিকায় পরিণত হয়েছে।
(৩) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বিচার বিভাগীয় তিনপ্রকার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারেন, কোন দণ্ডিত ব্যক্তির শাস্তি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখবার আদেশ দিতে পারেন; অথবা ঘোষণার দ্বারা একই সঙ্গে এবং একই অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিসমষ্টির প্রতি শাস্তিমূলক আদেশ সামগ্রিকভাবে মুকুব করে দিতে পারেন। কিন্তু Impeachment বা বিশেষ অভিযোগের বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির উল্লিখিত ক্ষমতা প্রযুক্ত হতে পারে না। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসন বিভাগের কর্তা হিসাবে নিজ ইচ্ছায় বিচার-সংক্রান্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন।
মূল্যায়ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি একাধারে দলীয় নেতা ও জাতির নেতা। রাষ্ট্রপতি উইলসন বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জাতির অথবা দলের নেতা হতে পারেন কিংবা তিনি উভয়ের নেতৃত্ব করতে পারেন। জাতির নেতৃত্ব করতে চাইলে দল তাঁকে বাধা দিতে পারে না। অবশ্য রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষমতা মর্যাদা অনেকখানি নির্ভর করে পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার ওপর। রাষ্ট্রপতির মর্যাদা তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।