ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির হাতে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক শাসকের ভূমিকা গ্রহণ করে দায়িত্ব পালন করেন। শাসন পরিচালনার প্রকৃত দায়িত্ব বহন করেন পার্লামেন্টের নিকট দায়িত্বশীল মন্ত্রিগণ। সেইজন্য রাষ্ট্রপতিকে শাসন পরিচালনায় মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। ভারতীয় সংবিধানের ৭৪ ধারায় বলা হয়েছে: ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংশোধন আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশ দান করে যে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। ১৯৭৯ সালের ৪৪তম সংশোধন আইনে এই অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের কোন পরামর্শ পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ পুনরায় সেই একই পরামর্শ দান করলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী
(১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ভারতীয় সংবিধানে ইউনিয়নের সমগ্র শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত ক্ষমতা বলতে নীতি নির্ধারণ এবং ঐ নীতি কার্যকর করা, শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ প্রভৃতি সকল কিছুই বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সাধারণ শাসন পরিচালনার সকল কিছুই শাসন বিভাগীয় ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানবিদগণ শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা বলতে মূলত ৪টি ক্ষমতার উল্লেখ করেন, যথা—(ক) প্রশাসনিক ক্ষমতা, (খ) সামরিক ক্ষমতা, (গ) কূটনৈতিক ক্ষমতা এবং (ঘ) বিচার-সংক্রান্ত ক্ষমতা। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তাঁর কর্মচারীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। রাজ্যপালকে নিয়োগ ও পদচ্যুত করা, এটর্নি জেনারেল ও ইউনিয়নের মন্ত্রিগণকে নিয়োগ ও পদচ্যুত করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। তিনি হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ, অডিটার জেনারেল, নির্বাচন কমিশনার, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, আন্তঃরাজ্য পরিষদের সদস্যগণকে এবং তপসিলী জাতি ও উপজাতি কমিশন, অনুন্নত শ্রেণী সম্পর্কিত কমিশন, সরকারী ভাষা কমিশন প্রভৃতি নিয়োগ করেন। অবশ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতি বা কোন সদস্যকে পদচ্যুত করবার পূর্বে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করতে হয়।
সামরিক ও পররাষ্ট্র সম্পর্কীয় ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের প্রধান সেনাপতি। রাষ্ট্রপতি আইন অনুসারে তাঁর প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন। অর্থাৎ পার্লামেন্টের আইন ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপন করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কার্যকর করতে পারেন না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন এবং পররাষ্ট্রের কূটনৈতিকগণকে গ্রহণ করেন।
(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীর মত রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অঙ্গ। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন, স্থগিত রাখেন; নিম্নকক্ষ লোকসভাকে ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। অধিবেশন আহ্বানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে লক্ষ্য রাখতে হয় যে, দুটি অধিবেশনের মধ্যে যেন ৬ মাসের অধিক ব্যবধান না থাকে। তিনি উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১২ জন সদস্য মনোনীত করেন এবং নিম্নকক্ষে দুজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্য মনোনীত করতে পারেন। তিনি পার্লামেন্টে বাণী পাঠাতে পারেন এবং উভয় কক্ষে অথবা যে-কোন কক্ষে ভাষণ দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে রূপলাভ করতে পারে না। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বিল গৃহীত হবার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। অর্থসংক্রান্ত বিল ছাড়া অন্য বিল তিনি পার্লামেন্টের পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন তবে বিলটি দ্বিতীয়বার উভয় কক্ষে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতিকে সম্মতি দিতে হয়। রাষ্ট্রপতির বিলে অসম্মতি জানাবার ক্ষমতা ‘ভিটো’ (veto power) নামে খ্যাত।
পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতি Ordinance বা ‘অস্থায়ী জরুরী আইন’ জারি করতে পারেন। এই আইন সংসদ-প্রণীত আইনের মতই বলবৎ হয়। তবে পার্লামেন্টের অধিবেশন আরম্ভ হবার পর আইনটি উভয় কক্ষের নিকট উপস্থিত করতে হয়। অধিবেশন আরম্ভের পর থেকে ছয় সপ্তাহকাল অর্ডিন্যান্স বলবৎ থাকতে পারে। কোন বিষয় জরুরী, তা বিচার করবার ক্ষমতা একমাত্র রাষ্ট্রপতির থাকে। রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্স নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই প্রত্যাহার করতে পারেন। বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ‘সন্তুষ্টি’ই জরুরী আইন জারি করবার পক্ষে পর্যাপ্ত বলে বিচারালয় স্বীকার করেছে। সংবিধানের ৪৪তম সংশোধন আইনে এই বিষয়ে আদালতের ক্ষমতা সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইনের (National Security Act, NSA) বৈধতার প্রশ্ন-সম্পর্কিত রিট আবেদনের ক্ষেত্রে ১৯৮১ সালের ২৮ ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্ট রায় দান প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স বা জরুরী আইন জারী করবার পর ক্ষমতাটিকে প্রশাসনিক ক্ষমতা নয়, আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা বলেই স্বীকার করেছেন।
(৩) অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা: সংবিধান অনুযায়ী প্রতি আর্থিক বছরে পরবর্তী বছরের আয়ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব বা বাজেট রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নিকট উপস্থিত করেন। রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোন ব্যয় মঞ্জুরীর প্রস্তাব পার্লামেন্টে উপস্থিত করা যায় না। কর বা ঋণসংক্রান্ত রাজস্ব প্রস্তাব বা সংশোধন উত্থাপনের জন্যও রাষ্ট্রপতির সুপারিশ প্রয়োজন হয়। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রতি ৫ বছর অন্তর একটি অর্থ কমিশন (Finance Commission) গঠন করেন।
(৪) বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা: ক্যাবিনেট বা পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় শাসক প্রধানের মত রাষ্ট্রপতি কিছু বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাও ভোগ করেন। তিনি অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন, দন্ডাজ্ঞা হ্রাস করতে পারেন। মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে কারাদন্ড দিতে পারেন।
(৫) জরুরী অবস্থা-সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির হাতে তিন ধরনের জরুরী অবস্থার ঘোষণা-সংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। (ক) জরুরী অবস্থার ঘোষণা, (খ) অঙ্গরাজ্যের শাসন ব্যবস্থার অচলাবস্থা-সংক্রান্ত ঘোষণা এবং (গ) আর্থিক জরুরী অবস্থার ঘোষণা। সংবিধানের ৩৫২ ধারায় বলা হয়েছে, সমগ্র ভারতে বা এর কোন অংশে যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা অন্তবিপ্লবের আশঙ্কা দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কোন অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের বিবরণ পাঠের পর রাষ্ট্রপতির যদি ধারণা হয় যে ঐ রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালনা সম্ভব নয়, তা হলে সাংবিধানিক অচলাবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। তৃতীয়ত, আর্থিক সংকট উপস্থিত হলেও রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা
ভারতীয় রাষ্ট্রপতির উপরোক্ত ব্যাপক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক বলে দাবি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীগণকে নিয়োগ করেন, ইচ্ছা করলে তাঁদের পদচ্যুতও করতে পারেন। কারণ সংবিধান অনুসারে মন্ত্রীরা তাঁর অধস্তন কর্মচারী বিশেষ।
কিন্তু সংবিধান-প্রণেতাগণ সহ আরও অনেকে রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক হিসেবে মেনে নিতে মোটেও রাজি নন। ড. আম্বেদকর বলেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ইংল্যান্ডের রাজা বারানির ন্যায় একজন নামসর্বস্ব শাসক। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কিন্তু শাসন বিভাগের প্রধান নন। তিনি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য। ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য।
উপসংহার
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা এবং সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। লোকসভায় কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে রাষ্ট্রপতি বিশেষভাবে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। একথায়, রাষ্ট্রপতি সর্বস্ব ক্ষমতার অধিকারী হলেও, তিনি আসলে ঠুঁটো জগন্নাথ।