সংবিধানের ১১০ ধারা অনুযায়ী যে বিলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ থাকে তাই অর্থবিল বা Money Bill বলে গণ্য করা হয়: (ক) কোন কর ধার্য, বিলোপ, পরিহার বা পরিবর্তন; (খ) ভারত সরকার ক গ্রহণ; (গ) কেন্দ্রীয় সঞ্চিত তহবিল (Consolidated Fund) থেকে অর্থ বিনিয়োগ; (ঘ) কোন ব্যয় তহবিলের ওপর ধার্য বলে ঘোষণা বা ঐ ব্যয়বৃদ্ধি; (ঙ) কেন্দ্রীয় সঞ্চিত তহবিল বা সরকারী গণিতক খাতে অর্থ গ্রহণ বা ব্যয়; অথবা (চ) উপরি-উক্ত যে-কোনটির আনুষঙ্গিক বিষয়। এছাড়া অর্থবিল কিনা সেই বিষয়ে স্পীকারের সিদ্ধান্তই চরম বলে গণ্য হবে।
ভারতীয় পার্লামেন্টে অর্থবিল পাসের পদ্ধতি
ভারতীয় পার্লামেন্টে অর্থবিল পাসের পদ্ধতি সম্পর্কে সংবিধানের ১০৯ নং ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে কোনো অর্থবিল আইনে রূপান্তরিত হয়।
(১) অর্থবিল শুধুমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপন করা যায়। রাজ্যসভায় কোনো অর্থবিল উত্থাপন করা যায় না। রাষ্ট্রপতির সুপারিশে শুধুমাত্র মন্ত্রীরা অর্থবিল উত্থাপন করেন। ‘সাধারণ বিল’ পাসের জন্য প্রতিটি বিলকে যেভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠ, কমিটি পর্যায়, তৃতীয় পাঠ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় অনুরূপভাবে অর্থবিলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
(২) অর্থবিল লোকসভায় গৃহীত হলে তা রাজ্যসভার কাছে সুপারিশের জন্য পাঠানো হয়। অর্থবিলকে প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার কোনো ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভার ক্ষমতা সংবিধানের ১০১ ধারার নির্দেশ অনুযায়ী সীমাবদ্ধ। রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে অর্থবিল সুপারিশসহ লোকসভায় পাঠিয়ে দিতে হয়। যদি ওই সময়ের মধ্যে বিলটি ফেরত না আসে তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে পার্লামেন্টে বিলটি গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ ১৪ দিনের বেশি রাজ্যসভা অর্থবিল আটকে রাখতে পারে না।
(৩) পার্লামেন্টে অর্থবিল গৃহীত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি কোনো অর্থবিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টে ফেরত পাঠাতে পারেন না। অর্থবিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান একটি নিছক আনুষ্ঠানিক ব্যাপার।
ভারতে অর্থবিল অনুমোদনের ব্যাপারে লোকসভার সামগ্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু লোকসভার এই প্রাধান্য মন্ত্রীপরিষদ পরিচালিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বহুলাংশে তত্ত্বগত বলে অনেকে মনে করেন। বস্তুত অর্থবিল-সম্পর্কিত লোকসভার আলোচনা আনুষ্ঠানিক প্রকৃতির। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরা মন্ত্রীদের উত্থাপিত অর্থবিল কার্যত বিনা আলোচনায় পাস- করানোর জন্য তৎপর থাকেন। তা ছাড়া অর্থবিল নিয়ে আলোচনার জন্য বরাদ্দ সময় অত্যন্ত অল্প থাকে। এর ওপর অর্থবিলের প্রকৃতি এমনিতেই জটিল হওয়ায় তা আলোচনার জন্য যে ধরনের বিশেষীকৃত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, অধিকাংশ সদস্যদের মধ্যে তা দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে অর্থবিলের বিষয়ে লোকসভার কর্তৃত্ব প্রধানত মন্ত্রীসভা ভোগ করে থাকে।
বাজেট পেশ
সংবিধানে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি প্রত্যেক আর্থিক বছর সম্পর্কে আনুমানিক আয়-ব্যয়ের হিসাব বা বাৎসরিক অর্থ-বিবরণী পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে উপস্থিত করাবেন। অর্থমন্ত্রী লোকসভায় বাজেট পাস করান এবং বাজেট সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদান করেন। সরকারী ব্যয়ের হিসাবকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়—(১) সঞ্চিত তহবিলের ওপর ধার্য ব্যায়, এবং (২) সঞ্চিত তহবিল থেকে অন্যান্য বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যায়। দ্বিতীয় ব্যয়ের জন্য প্রতি বছর পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সঞ্চিত তহবিলের উপর ধার্য ব্যয় পার্লামেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষ নয়। রাষ্ট্রপতির বেতন, ভাতা, রাজ্যসভা ও লোকসভার সভাপতি ও সহ-সভাপতির বেতন ও ভাতা সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের বেতন, ভাতা ও পেনসন, সরকারী ঋণ ইত্যাদি সঞ্চিত তহবিলের ওপর ধার্য ব্যয়।
অনুমোদন সাপেক্ষ ব্যয়
দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যয়গুলি লোকসভার অনুমোদনসাপেক্ষ। পার্লামেন্টে বাজেট উপস্থিত করবার পর অনুমোদনসাপেক্ষ ব্যয়গুলি মঞ্জুরীর জন্য দাবি উপস্থিত করা হয়। এবং ঐ সম্পর্কে আলোচনা ও ভোট গ্রহণ করা হয়। লোকসভা কোন ব্যয় হ্রাস বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে, কিন্তু ব্যয় বৃদ্ধি বা নতুন ব্যয়ের প্রস্তাব করতে পারে না। ব্যয় মঞ্জুরীর দাবি নিয়ে আলোচনা জন্য স্পীকার নির্দিষ্ট সময় ধার্য করেন। ঐ সময়ের মধেই দাবির বিচার-বিবেচনা ও ভোট গ্রহণ শেষ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে আলোচনা শেষ না হলে, আলোচনা ব্যতিরেকে অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বিনিয়োগ আইন
ব্যয় মঞ্জুরীর দাবি অনুমোদিত হলে যথাসম্ভব শীঘ্র বিনিয়োগ আইন (Appropriation Act) পাস করে সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ তুলবার ক্ষমতা দেওয়া হয়। সরকারের সকল অর্থই সঞ্চিত তহবিলে জমা থাকে। এই সকল কাজ সমাপ্ত হলে নতুন আর্থিক বছর আরম্ভ হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের আইন ছাড়া কোন অর্থ ব্যয় করা যায় না। সেইজন্য লোকসভা সরকারকে কিছু আগাম অর্থ ব্যয়ের অনুমতি প্রদান করে, একে Vote on Account বলা হয়। তাছাড়া, চলতি বছরে কোন বিষয় সম্পর্কে মঞ্জুরীকৃত ব্যয় অপ্রচুর হলে পরিপূরক ব্যয়ের (Supplementary Grants) জন্য দাবি পেশ করে মঞ্জুর করাতে হয়। অনুমোদিত ব্যয়ের অধিক ব্যয় হলেও পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন।
অর্থবিল ও ফাইন্যান্সিয়াল বিল
সরকার আইনের সম্মতি ছাড়া কোন কর ধার্য বা সংগ্রহ করতে পারে না। সরকারের কর বা রাজস্ব-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি ‘Finance Bill’ নামে পার্লামেন্টে উপস্থাপিত করা হয়। বাজেটের সঙ্গে একই সময়ে রাজস্ব বিল উপস্থিত করা হয়। নতুন কর বৃদ্ধি বা কর প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য এরূপ কোন সংশোধন রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত করা যায় না। এ প্রসঙ্গে অর্থবিল ও অন্যান্য অর্থ-সম্বন্ধীয় বিল বা ফাইন্যান্সিয়াল বিল বলা যেতে পারে। অর্থবিল এবং রাজস্ব বিল ফাইন্যান্সিয়াল বিলের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু যে-কোন ফাইন্যান্সিয়াল বিল অর্থবিল নয়। স্পীকার অর্থ বিল বলে যে ফাইন্যান্সিয়াল বিলে স্বাক্ষর দান করেন তাই অর্থবিল। অর্থবিল রাষ্ট্রপতির অনুমতি ভিন্ন উত্থাপন করা যায় না এবং রাজ্যসভায় তার ওপর ভোট নেওয়া যেতে পারে।