শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পাঠ্যপুস্তক—এই তিনের মধ্যে গভীর একাত্মতা সাযুজ্য গড়ে উঠলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান সার্থক ও ফলপ্রসূ হবে। এই গভীর একাত্মতা গড়ে তোলার ভার ইতিহাস শিক্ষকের ওপর। ইতিহাস শিক্ষককে যদি গুরুদায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করতে হয় তাহলে তাঁর উপযুক্ত যোগ্যতা ও গুণাবলী থাকা প্রয়োজন।
(১) ইতিহাস শিক্ষক যেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন। প্রশিক্ষণই পারে একজন শিক্ষককে আদর্শ শিক্ষক করে গড়ে তুলতে। ইতিহাস শিক্ষা প্রসঙ্গে পদ্ধতি নির্ধারণ, প্রয়োগ ও তার ফলাফল সম্পর্কে শিক্ষক অভিজ্ঞ হবেন। নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ লাভ করার পরেও ইতিহাস শিক্ষককে ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, নিত্য নতুন প্রকাশিত কোনো ইতিহাস পাঠ করে পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও অধিকতর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
(২) ইতিহাস শিক্ষককে ইতিহাস বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্থাৎ পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হবে। ইতিহাসের কতকগুলি বিষয় জানলেই তিনি ইতিহাসের শিক্ষক হতে পারেন না-বিষয় সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার গভীরতা থেকেই জ্ঞান আসে।
(৩) ইতিহাস শিক্ষক একদিকে যেমন ইতিহাসের মূল বিষয় জানবেন তেমনি অন্যদিকে আধুনিক ভাষা দর্শনের ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, সাধারণ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধেও জ্ঞান অর্জন করবেন।
(৪) ইতিহাসের শিক্ষককে নৃতত্ত্বের (Anthropology) সম্বন্ধেও বুনিয়াদি জ্ঞান আহরণ করতে হবে। মানবসভ্যতা কীভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল এ সমস্তই তাঁর জানা থাকা প্রয়োজন।
(৫) ইতিহাসের শিক্ষক হবেন বিস্তৃত পরিধি সংযুক্ত কৃষ্টির অধিকারী। তিনি মানুষের অতীত যুগ হতে বর্তমান পর্যন্ত কৃষ্টির সন্ধান ও উৎসাহ দেবেন। অতীত ও বর্তমান কৃষ্টির সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভ করবেন। শিল্প, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, মানবিকতা, সংগীত, স্থাপত্য প্রভৃতি সকল বিষয়ে তাঁকে সম্যক জ্ঞানলাভ করতে হবে।
(৬) ইতিহাসের বিষয়বস্তু হল মানুষ ও তার বিচিত্র কর্মকাণ্ড। ইতিহাস শিক্ষক হবেন প্রকৃত মানব দরদি। তাঁকে প্রকৃত মানবতার ধর্মসম্পন্ন হতে হবে, নইলে তিনি ছাত্রদের নিকট প্রকৃত দরদ দিয়ে ইতিহাস উপস্থাপিত করতে পারবেন না।
(৭) ইতিহাস শিক্ষককে আন্তর্জাতিক মনোভাবাপন্ন হতে হবে। তিনি ছাত্রদের মনে আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব (International understanding) বোধ জাগ্রত করবেন। তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে অনুসন্ধান করতে হবে পৃথিবীর কোথায় কোথায় কীভাবে মানুষে মানুষে মিলনের মঞ্চ গড়ে তোলবার শুভ চেষ্টা হয়েছিল, আবার কী কারণে শুভ প্রচেষ্টা বিনষ্ট হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তিনি হবেন ‘A world-minded-teacher’। তিনি আন্তর্জাতিকতা বিকাশে নিজের পাঠদান পদ্ধতি পরিবর্তন করবেন। এজন্য তাঁকে রীতিমতো জাতীয় ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস অধ্যয়ন করার অভ্যাস রাখতে হবে।
(৮) ইতিহাস শিক্ষককে শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের (Educational Psychology) মোটামুটি জ্ঞানলাভ করতে হবে। শিক্ষক মহাশয় ছাত্রদের সামর্থ্য, চাহিদা ও পরিবেশ লক্ষ করে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলিকে শিক্ষা দিতে সাহায্য করবেন।
(৯) ইতিহাস শিক্ষককে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে উদার হতে হবে। ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করছে। সুতরাং তাঁর মধ্যে বিশেষ কোনো রকমের ধর্মের গোঁড়ামি থাকবে না। তিনি সকল ধর্মকে সমান চোখে দেখবেন ও শ্রদ্ধা জানাবেন। যে-কোনো মতবাদকে সহ্য করবার এবং সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবার মতো তাঁকে ধৈর্যশীল হতে হবে।
(১০) ইতিহাস শিক্ষকের মন হবে উদার, সহিষ্ণু, উন্মুক্ত ও আত্মাভিমান শূন্য। তাঁকে নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে।
(১১) নানা পরিবেশে ধৈর্য ধারণ, ভুল স্বীকার করবার সৎ সাহস ইতিহাস শিক্ষকের থাকা চাই। যদি থাকে তবে তিনি দায়িত্ব পালনে সমর্থ হবেন ও কৃতকার্য লাভ করবেন।
(১২) ইতিহাস পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে ‘শিক্ষোপকরণগুলি’ (aids) সম্বন্ধে তাঁকে যথাযথ জ্ঞানলাভ করতে হবে। আবার এসব শিক্ষোপকরণগুলি শ্রেণিকক্ষে কখন কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞানলাভ করতে হবে। পাঠের সঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ডের সুষ্ঠু ব্যবহার করবার কৌশল তাঁকে আয়ত্ত করতে হবে।
(১৩) শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্যপুস্তক একটি অপরিহার্য ও আবশ্যকীয় সামগ্রী। আধুনিক শিক্ষাধারায় পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শিক্ষাকর্ম পরিচালনা করা যায় না। পাঠ্যপুস্তকের নীতিসম্মত ব্যবহার সম্বন্ধে শিক্ষককে শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হবে। উপস্থাপিত বিষয়বস্তুর সন্ধান, পাঠ্যপুস্তক থেকে সারসংক্ষেপ প্রভৃতি সম্বন্ধে শিক্ষকের যথেষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা, কৌশল ও সামর্থ্য থাকা চাই।
(১৪) ইতিহাসের শিক্ষক হবেন সত্যনিষ্ঠ। তিনি সত্যকে নিষ্ঠার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবেন। শিক্ষকের বিবরণীর মধ্যে থাকবে একান্ত নিখুঁত সত্য। তিনি অন্ধ বিশ্বাসী হবেন না।
(১৫) শিক্ষকের একটি অন্যতম গুণ হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’—এই মনোভাব শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে গড়ে তুলবেন। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ সহকারে বসবাস করা, প্রত্যেকের সুখে-দুঃখে সংবেদনশীল হবার শিক্ষা শিক্ষক দেবেন। স্থানীয় বিভিন্ন সমাজের মধ্যে, জাতির মধ্যে এবং পৃথিবীর মধ্যে সহযোগিতার ফল সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে তুলে ধরবেন।
(১৬) ইতিহাস শিক্ষকের মন হবে কল্পনামধুর অথচ বিশ্লেষণাত্মক বাস্তববাদী। তিনি হবেন নব নব পরিকল্পনার উৎসাহদাতা। তিনি বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে ছাত্রদের কাছে উপস্থাপিত করবেন।
(১৭) ইতিহাস শিক্ষক হবেন অফুরন্ত উৎসাহের উৎস। তাঁর অন্তর আন্তরিক অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা আর সত্যানুসন্ধানের মানসিকতা গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করবেন।
(১৮) ইতিহাস শিক্ষকের সুললিত কণ্ঠ থাকা চাই। ভালো আবৃত্তি করার দক্ষতা থাকা চাই। কথাবার্তার মধ্যে সামাজিকতা ও বাকচাতুর্য থাকা চাই।
(১৯) পড়াতে পড়াতে একঘেয়েমি কাটাবার জন্য অতি উন্নতমানের রসবোধ (Sense of humour) সৃষ্টি করবার ক্ষমতা শিক্ষকের অবশ্য থাকা চাই। কারণ সরস অভিব্যক্তি ছাড়া তাঁর বর্ণিত মানুষের কাহিনি নীরস হয়ে উঠবে।
(২০) ইতিহাস শিক্ষকের দৈহিক গঠন সুন্দর হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
(২১) ইতিহাস শিক্ষকের অবশ্যই গল্প বলার কৌশল জানা প্রয়োজন। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষাদান করলে তা শিশুদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।
(২২) ইতিহাস শিক্ষকের নেতৃত্ববোধ (Leadership quality) থাকা চাই। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজে, ধর্মে, রাজনীতিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করে এক সুন্দরতর পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে সে সম্বন্ধে ইতিহাস শিক্ষক ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ চরিত্রগুলি বিশেষভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন।
(২৩) ঐতিহাসিক ক্রমগতি, ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক প্রভৃতি ও কার্যকারী প্রভাব সম্পর্কে ইতিহাস শিক্ষকের গভীর জ্ঞান ও সচেতন থাকা বিশেষ প্রয়োজন।
(২৪) ইতিহাসের শিক্ষককে শিক্ষণ বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হবে। শিক্ষাদানের সক্রিয় পদ্ধতি ও কৌশল শিখতে হবে। পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের কৌশল জানতে হবে। সুপরিচিত শিক্ষাদান প্রণালী জানতে হবে। বৈচিত্র্যময় পন্থা অনুসরণের জন্য তাঁকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
(২৫) ইতিহাস শিক্ষায় ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানগুলিতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ইতিহাস শিক্ষকের থাকা চাই। ঐতিহাসিক নির্দশনগুলির চিত্র (বিখ্যাত ইমারত, গির্জা, মন্দির, মসজিদ, দুর্গ, সমাধি সৌধ, বিষয়বস্তু, নানা স্থাপত্য) ভ্রমণের সময়ে তিনি অবশ্যই সংগ্রহ করবেন। শিক্ষাদান কালে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপিত করবেন। তাহলে বিষয়বস্তু সরস ও রসগ্রাহী হয়ে উঠবে, শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়বে।
(২৬) ইতিহাস বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়। তাই ইতিহাস শিক্ষকের মন হবে বিশ্লেষণাত্মক। তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ঘটনা বিচারবিশ্লেষণ করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপিত করবেন। প্রকৃত ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে তিনি বিষয় চর্চা করবেন। শিক্ষার্থীকে সত্যানুসন্ধানী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন।
(২৭) ইতিহাস বিষয়ের সঙ্গে ভূগোল, সাহিত্য, পৌরবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, নৃত্য, সংগীত, শিল্প প্রভৃতি নানা বিষয়ের সম্বন্ধ আছে। উক্ত সকল বিষয়ের সঙ্গে অনুবন্ধ প্রণালী (correlation) করে পাঠদানের যোগ্যতা ইতিহাস শিক্ষকের থাকা চাই।
(২৮) ইতিহাস শিক্ষক স্নেহপ্রবণ হবেন। যদি ছাত্র ভুল উত্তর দেয় তবে তাকে তিরস্কার না করে শুদ্ধ উত্তর বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
(২৯) ইতিহাস শিক্ষককে পরিমিত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। তিনি বস্তুনিষ্ঠ হবেন। তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে শিক্ষার্থী যেন নিষ্প্রভ না হয়ে পড়ে।
(৩০) শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় বিবিধ চিত্র, নকশা, ডায়াগ্রাম ও রেখা মানচিত্র প্রভৃতি অঙ্কন করবার দক্ষতা ও যোগ্যতা ইতিহাস শিক্ষকের থাকা চাই।
(৩১) ইতিহাস শিক্ষক বিতর্কমূলক কথোপকথনে পারদর্শী হবেন। মাঝে মাঝে তিনি শ্রেণিকক্ষে ইতিহাসের বিষয় নিয়ে বিতর্ক সভার আয়োজন করবেন। তবেই ছাত্রদের মধ্যে বিচার বিশ্লেষণ করার মনোভাব সৃষ্টি হবে।
(৩২) ইতিহাস শিক্ষককে দেশাত্মবোধক সংগীত জানতে ও শিখতে হবে। তাঁকে চারণ কবিদের কবিতা, উদ্দীপ্ত কবিতা ও ছন্দবদ্ধ কবিতা প্রভৃতি মুখস্থ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় সংগীতের ও কবিতা আবৃত্তির বিশেষ প্রয়োজন হয়।
(৩৩) ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ অংশ অভিনয়ের মাধ্যমে পড়ানোর জন্য অভিনয়ে দক্ষ হতে হবে।
(৩৪) ইতিহাস শিক্ষককে স্বীয় কর্মের প্রতি, স্বীয় বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে হবে।
(৩৫) ইতিহাস শিক্ষককে ইতিহাস বিষয় ছাড়াও নানা শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা পাঠ এবং নিত্য নূতন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতা থাকা চাই।
(৩৬) ইতিহাসের শিক্ষককে সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে গভীর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নইলে ইতিহাস কক্ষ সংগঠন, কর্মের মাধ্যমে শিক্ষাদান ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ভ্রমণ, প্রদর্শনী ও অভিনয়ের ব্যবস্থাপনা, উপকরণাদি সংগ্রহে সাফল্যলাভ করতে পারবেন না।
(৩৭) একটি সুসজ্জিত ইতিহাস কক্ষ (History Room) পরিচালনায়, বিষয়বস্তু সাজানো, বাছাইকরণ ও প্রস্তুতকরণে তিনি সিদ্ধহস্ত হবেন।