সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক বলা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণ কতকগুলি ব্যবস্থার মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই ব্যবস্থাগুলি হল গণভোট, গণ-উদ্যোগ ও গণসমাবেশ। এই পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে জনগণের আইন প্রণয়নে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বলে সুইজারল্যান্ডের জনগণকে অনেক সময় ‘তৃতীয় কক্ষ’ বলে অভিহিত করা হয়। সুইস শাসন ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী জনসাধারণ গণভোট (Referendum), গণ-উদ্যোগ (Initiative) ও গণ-সমাবেশের (Popular Assembly) মাধ্যমে আইন প্রণয়নে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতে পারে, কারণ এখানে আইনসভার মাধ্যমে ও গণভোটের মাধ্যমে এইভাবেই জনমত প্রকাশিত হতে পারে। গণভোট এবং গণ-উদ্যোগই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন জনগণের সমর্থনের অথবা বর্জনের জন্য পেশ করা হলে তা গণভোট বলে পরিচিত হয়। অন্যদিকে, গণ-উদ্যোগের ক্ষেত্রে জনগণ অগ্রণী হয়ে আইনসভার কাছে আইনের প্রস্তাব পেশ করে। গণভোট অকাম্য আইন প্রণয়ন প্রতিহত করতে পারে এবং গণ-উদ্যোগ জনগণের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে সক্রিয় যন্ত্র হিসাবে স্বীকৃত।
গণভোট (Referendum)
গণভোট দু’প্রকারের হতে পারে—ইচ্ছাধীন (optional) ও বাধ্যতামূলক (compulsory) গণভোট। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রের সংশোধন ব্যাপারে বাধ্যতামূলক গণভোটের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণ আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্বন্ধে গণভোট হল ইচ্ছাধীন গণভোট। গণভোটের প্রকৃত অর্থ হল আইনসভা-প্রণীত আইনকে ভোটের দ্বারা অনুমোদন বা প্রত্যাখানের জন্য জনসাধারণের নিকট উপস্থিত করা। শাসনতান্ত্রিক বাধ্যতামূলক গণভোটের ক্ষেত্রে অধিকাংশ নাগরিক ও ক্যান্টনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়, কিন্তু ইচ্ছাধীন গণভোটের ক্ষেত্রে ভোটপ্রদানকারী নাগরিকগণের অনুমোদন থাকলে চলে। তা ছাড়া যে সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য নয়, অথবা তা জরুরী প্রকৃতির হলে সেই প্রস্তাব গণভোটে উপস্থিত করা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভাই আইনটি প্রকৃত জরুরী কিনা তা নির্ধারণ করে। ক্যান্টনগুলির শাসনতন্ত্র সংশোধনের জন্য বাধ্যতামূলক গণভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। কতকগুলি ক্যান্টনে সাধারণ আইনের ক্ষেত্রেও বাধ্যতামূলক গণভোট প্রযুক্ত হয়ে থাকে।
গণ-উদ্যোগ (Initiative)
গণ-উদ্যোগ বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচক কর্তৃক উত্থাপিত আইনের প্রস্তাব। গণ-উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান সংশোধনে প্রযুক্ত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হয় না। অধিকাংশ ক্যান্টনে সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে গণ-উদ্যোগ ব্যবস্থা আছে; সাধারণ আইন সম্পর্কেও ক্যান্টনগুলিতে গণ-উদ্যোগ প্রযুক্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের সংশোধন দু’প্রকারে হতে পারে — সামগ্রিক (total) ও আংশিক (partial) পরিবর্তন। উভয় ক্ষেত্রেই ৫০ হাজার নাগরিক গণ-উদ্যোগের মাধ্যমে সংবিধানের সংশোধন দাবী করতে পারে। সামগ্রিক সংশোধনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধিত হবে কি না—এই প্রশ্নটি গণভোটে মীমাংসা করা হয়। গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করলে আইনসভা ভেঙ্গে দিয়ে নূতনভাবে নির্বাচন হয়। নূতন আইনসভা সংবিধানের সংশোধন করে গণভোটের মাধ্যমে নাগরিক ও ক্যান্টনসমূহের নিকট উপস্থিত করে। অধিকাংশ নাগরিক ও ক্যান্টন কর্তৃক অনুমোদিত হলে ঐ সংশোধন কার্যকর হয়।
সংবিধানের আংশিক সংশোধনের পদ্ধতি সংশোধন প্রস্তাব কোন আকারে উত্থাপিত হবে তার উপর নির্ভর করে। গণ-উদ্যোগ দু’প্রকারের হতে পারে — নির্দিষ্ট (formulative) ও সাধারণ (unformulative)। সাধারণ আকারের সংশোধন প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার নাগরিক সাধারণভাবে কোন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইচ্ছা জানায়; নির্দিষ্ট আকারের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে জনসাধারণ প্রস্তাবটি একটি বিলের আকারে উপস্থিত করে। সাধারণ প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা অনুমোদন জানালে প্রস্তাব অনুযায়ী খসড়া রচন। করে এবং জনসাধারণ ও ক্যান্টনগুলির অনুমোদনের জন্য উপস্থিত করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার অনুমোদন না থাকলে প্রশ্নটি সম্পর্কে গণভোটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন থাকলে আইনসভা সংশোধন কার্যে অগ্রসর হয় এবং পরে সংশোধনকে জনসাধারণ ও ক্যান্টনগুলির নিকট গণভোটের জন্য উপস্থিত করা হয়।
সম্পূর্ণ বিলের আকারে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে এবং আইনসভা তাতে সম্মতি দান করলে প্রস্তাবটি জনসাধারণ ও ক্যান্টনগুলির ভোটের জন্য উপস্থাপিত করা হয়। কিন্তু আইনসভা তাতে সম্মত না হলে উক্ত প্রস্তাবটি এবং প্রস্তাবটি গ্রহণ না করবার কারণসহ একটি সুপারিশপত্র পূর্ব প্রকার ভোটের জন্য উপস্থাপিত করতে পারে। আইনসভা একটি বিকল্প প্রস্তাব রচনা করে গণউদ্যোগে আনীত প্রস্তাবের সঙ্গে জনসাধারণ ও ক্যান্টনের ভোটের জন্য পেশ করতে পারে। সকলক্ষেত্রেই ক্যান্টন ও ভোটপ্রদানকারী জনগণের অধিকাংশের সমর্থন প্রয়োজন।
গণ-সমাবেশ (Popular Assembly)
গণ-সমাবেশকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। সুইজারল্যান্ডের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারা বহন করেই গণসমাবেশের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। যে সকল ক্যান্টনে গণসমাবেশের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকগণ সরকারী নীতি নির্ধারণে, আইন প্রণয়নে এবং শাসন পরিচালনার সুষ্ঠু নীতি উদ্ভাবনে একত্র মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শাসনবিভাগীয় কর্তৃপক্ষের বিচার ও পদস্থ কর্মচারী নিয়োগের কার্য গণসমাবেশে হয়ে থাকে। বর্তমানে কয়েকটি ছোটো ক্যান্টনে এই ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন ক্যান্টনে রাজ্য পরিষদের সদস্যগণকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পদচ্যুত করার (Recall) ব্যবস্থা রয়েছে। গণ-সমাবেশের মধ্যেই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সর্বাধিক প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটি
সুইজারল্যান্ডে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কিন্তু গণভোট, গণ-উদ্যোগ ও গণ-সমাবেশের অনেক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত, প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি তত্ত্বগত এবং বাস্তব উভয় প্রকার দোষযুক্ত। কারণ শিক্ষায় অপ্রাধান্যের জন্য কোন আইন বা আইনের খসড়া সম্পর্কে জনগণ সুদৃঢ় মতামত গঠন করতে সক্ষম নয়। তা ছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত নয়। এই ব্যবস্থায় সমগ্র বিলটি একক হিসাবে জনগণের সম্মুখে উপস্থাপিত হয়। কোন ধারা সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও বিলটিকে হয় সামগ্রিকভাবে গ্রহণ, না হয় সামগ্রিকভাবে বর্জন করতে হয়। সুতরাং এই পদ্ধতি দায়িত্ববোধ অপেক্ষা দায়িত্বহীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি আইনসভাকেও দায়িত্বহীন করে। আইনসভার সদস্যগণ মনে করেন যে, তাঁরা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে চরম ক্ষমতার অধিকারী নন। তাঁদের ভুলত্রুটি সম্পর্কে তাঁরা উদাসীন থাকেন, কারণ তাঁদের ভুলত্রুটি ধরবার জন্য জনসাধারণ রয়েছেন। গণভোট প্রবর্তনের ফলে আইনসভা শুধুমাত্র উপদেষ্টামূলক কমিটিতে পর্যবসিত হয়।
তৃতীয়ত, গণ-উদ্যোগে যে আইন প্রস্তাবিত হয় তা এত ত্রুটিপূর্ণ থাকে যে, অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তীকালে এই ত্রুটির জন্য অনেক মামলার উদ্ভব হয়।
চতুর্থত, এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে অনেকে সমালোচনা করেন। লর্ড ব্রাইস গণভোট ব্যবস্থা রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতির অন্তরায় বলে মন্তব্য করেছেন।
উপরিউক্ত ত্রুটি সত্ত্বেও সুইজারল্যান্ডে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে। আইনসভার দোষত্রুটি ও স্বৈরাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এটি সমর্থ হয়েছে। আইনসভার সার্বভৌম তৃতীয় কক্ষ হিসাবে কাজ করে জনসাধারণ শ্রেণীস্বার্থ-সম্পর্কিত আইনের বিরোধিতা করতে পারে। সুইস নাগরিকগণ সুস্থ রক্ষণশীলতা ও অগ্রগামী গণতান্ত্রিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করতে পেরেছে। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকগণের শিক্ষার ব্যাপক প্রসার প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সাফল্যের সহায়তা করেছে। লর্ড ব্রাইসের মতে, প্রত্যেক শাসন ব্যবস্থায় শেষ কথা বলবার একটি সংস্থা থাকে যার বিরুদ্ধে কোন আপীল চলে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই হচ্ছে শেষ কথা বলার অধিকারী।