আইন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্যতম বিষয় এবং নৈতিক বিধি নীতিশাস্ত্রের বিষয়। প্রাচীনকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানি, দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়কগণ আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না। প্রাচীন গ্রীসের প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ মনীষিগণ রাষ্ট্রীয় কাজকে নৈতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করবার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রাচীন ভারতেও আইন ও নৈতিক বিধি ধর্মের অঙ্গীভূত ছিল। সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে সত্যকথা বলা, পিতামাতা ও গুরুজনকে ভক্তি করা এবং সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করবার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নীতিকথাগুলি সকলে যাতে মান্য করে, যাতে সাধারণের নৈতিক জীবন উন্নত হয়, তার জন্যই অশোক ‘ধর্মমহামাত্র’ নামে একদল কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইতালির চিন্তানায়ক মেকিয়াভেলী সর্বপ্রথম শাসন পরিচালনায় বাস্তবতাবোধের ওপর প্রাধান্য আরোপ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নৈতিক বিধির প্রভাব হতে মুক্ত করেন।
আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্য
বর্তমানে আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে নানা কারণে পার্থক্য করা হয়।
প্রথমত, আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নৈতিক বিধি মানুষের সমগ্র জীবন; যথা— আচার-আচরণ, চিন্তা, অনুভূতি, বাস্তব কাজ সমস্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আইনের সঙ্গে মানুষের মন বা অনুভূতির কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। চুরি করার বা কাকেও হত্যা করবার ইচ্ছা পোষণ করা আইনত অপরাধ বলে গণ্য হয় না। চুরি করলে বা হত্যা করলেই আইনের এক্তিয়ারে আসে।
দ্বিতীয়ত, নৈতিক বিধির ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডেই সকল কাজের বিচার করে থাকে। কিন্তু আইন রচিত হয় সুবিধা-অসুবিধার মানদণ্ডে। সে কারণে অনেক বে-আইনী কাজ নীতি-বিগর্হিত নাও হতে পারে। যেমন, রাস্তার বাঁদিক দিয়ে গাড়ি চালানোই নিয়ম; এর অন্যথা হলে বে-আইনী হবে, কিন্তু নীতি-বিগর্হিত হবে না। নৈতিক বিধি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলে এটা সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট নয়। দেশ-কালের পার্থক্য অনুযায়ী নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যেতে পারে। আইন সমস্ত ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। সার্বজনীনতার জন্যই সমাজের সকলের ওপর আইন নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎ হয়। আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন রয়েছে।
তৃতীয়ত, আইন ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ শান্তির বিধান করতে পারে। কিন্তু নৈতিক বিধি ভঙ্গ করলে কোনরূপ দৈহিক শাস্তি ভোগ করতে হয় না। নীতি-বিগর্হিত কাজের শাস্তি হল সামাজিক নিন্দা ও বিবেকের দংশন।
আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে সম্পর্ক
আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক গেটেলের মতে, মানুষের নীতিবোধ রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রভাবিত করে থাকে। আইন সামাজিক নীতিবোধকে প্রতিফলিত করে। সমাজের নৈতিক মান উন্নত হলে রাষ্ট্রে আইন ব্যবস্থাও উন্নত ধরনের হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের মূল্য লক্ষ্য হল সমাজ জীবনে নৈতিক উৎকর্ষের পরিচায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। শাসন নীতির উৎকর্ষ নৈতিক ভিত্তিতে মূল্যায়ন করবার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইন অনেক সময় সমাজকে এক উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সমাজের প্রচলিত নীতিবোধের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন নীতিবোধের সৃষ্টি করে।
উদাহরণ হিসাবে ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিনের প্রচলিত সতীদাহ প্রথার উল্লেখ করা যায়। পূর্বে সতীদাহ ভারতীয় সমাজে নৈতিক বিধির সমর্থন লাভ করে। রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সতীদাহ প্রথা রোধ করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এটা কেবল বে-আইনী বলে গণ্য হলেও ক্রমশঃ সমাজের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটে এবং সতীদাহ নীতিবিগর্হিত, বর্বর প্রথা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুতরাং আইন দ্বারা কু-নীতির পরিবর্তে সু-নীতির প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
অধ্যাপক গিলক্রীস্ট বলেছেন, রাষ্ট্র যেমন একদিকে মন্দ আইন প্রতিরোধ করে সমাজের কল্যাণ সাধন করে, তেমনি অপরদিকে সমাজের নৈতিক মান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে সু-শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং নৈতিক বিধি সম্পর্কে রাষ্ট্রের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। আইন সামাজিক নীতিবোধের অনুগামী হলে সহজেই বলবৎ হয়। জনমতের সমর্থন লাভ না করলে আইন কার্যকর হতে পারে না। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির নৈতিক উপলব্ধিকে সহায়তা করা; সুতরাং রাষ্ট্রকে নৈতিক আদর্শ স্থির করে কাজ করতে হবে। আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য রূপ গ্রহণ করে; এ আইন সম্পূর্ণভাবে নৈতিক ধারণা হতে বিচ্যুত হতে পারে না। সুতরাং আইন ও নৈতিক বিধির সম্পর্ক মনে রাখতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে, নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতির ওপর নৈতিক ধারণা নির্ভরশীল। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি বা নীতিবোধের সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকবে। আইন ও নৈতিক বিধি উভয়ে উপরিসৌধের অন্তর্ভুক্ত বলে অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের সঙ্গে তারা পরিবর্তিত হয়। সমাজের জন্য কাজ করা, পারস্পরিক সহযোগিতা, ব্যক্তিস্বার্থ অপেক্ষা সামাজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া প্রভৃতি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি হিসাব স্বীকৃত হয়।