মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (U.S.A.) শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠান করেন রাষ্ট্রপতি (President)। রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র তত্ত্বগতভাবে নয়, বাস্তবে প্রধান শাসক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকার করবার ফলে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবার অধিকার লাভ করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের দরুণ মার্কিন কংগ্রেস বা আইনসভা (Legislature) স্বাধীনভাবে দায়িত্ব সম্পাদন করে। তথাপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতির ফলে আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগ পরস্পরকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের (আইনসভা) সম্পর্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ন্যায় আইনসভার অঙ্গ নন। রাষ্ট্রপতি বা তাঁর ক্যাবিনেট সদস্যগণ কেউই কংগ্রেসের (Congress) সদস্য হতে পারেন না। কংগ্রেসের নিকট তাঁদের কোন দায়িত্ব নেই। ক্যাবিনেটের সদস্যগণ তাঁদের কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী থাকেন এবং রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের প্রভাবমুক্ত হয়ে আপন দায়িত্বে শাসন-পরিচালনা করেন। কংগ্রেসকে রাষ্ট্রপতির নিকট অধীনতা স্বীকার করতে হয়। সুতরাং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রভাবের ফলে তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের মধ্যে কোন সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয় না।
(১) প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতি আইনসভার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন: প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন-বিষয়ক কাজ পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন যে, সাংবিধানিক আইন-বিষয়ক কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নেই। তিনি কংগ্রেসের কোন কক্ষের সদস্য নন। তিনি কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন না। আইনসভায় বিল উত্থাপনের কোন ক্ষমতা তাঁর নেই।
সংবিধানের বাধা-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রথাগত রীতি-নীতির ভিত্তিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ব্যাপক আইন-বিষয়ক ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে রাষ্ট্রপতির প্রভাব কার্যকর হয়েছে। কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রাষ্ট্রপতির সমর্থক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় আইন পাস করানো সম্ভব হয়।
(২) রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন-বিষয়ক কার্যে প্রভাব বিস্তার করেন: সংবিধানের দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে যে, বিশেষ বিশেষ সময়ে রাষ্ট্রপতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে কংগ্রেসকে সংবাদ জ্ঞাপন করতে পারেন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ করে থাকেন। রাষ্ট্রপতি সুপারিশ প্রেরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে কংগ্রেসকে বাধ্য করেন।
রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসন পরিচালনা সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। সংবাদপত্র এবং বেতার বক্তৃতা দ্বারা জনমত বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সুতরাং রাষ্ট্রপতির নির্দেশকে কংগ্রেসের না মেনে উপায় থাকে না। কারণ নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে জনমতের সমর্থন হারাবার সম্ভাবনা থাকে।
রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মচারী নিয়োগ করতে পারেন এবং সুযোগ-সুবিধা বিতরণ করে থাকেন। এই ক্ষমতার দ্বারা রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের অনেক সদস্যকে আপন সমর্থনে আনতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি আইনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীত কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। রাষ্ট্রপতি সম্মতিসূচক স্বাক্ষর না করলেও বিলটি আইনে পরিণত হয়। কিন্তু যদি কংগ্রেসের কোন একটি কক্ষে রাষ্ট্রপতির সমর্থনকারী এক-তৃতীয়াংশের অধিক সদস্য থাকেন তাহলে কোন বিলই আইনে পরিণত হতে পারে না। রাষ্ট্রপতির ‘ভেটো’ (Veto) ক্ষমতার জন্য কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নির্দেশকে অগ্রাহ্য করতে চায় না। ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের মারফতে রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তৃতীয় কক্ষে পরিণত হয়েছেন।
(৩) রাষ্ট্রপতির কার্যে কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যাতে স্বেচ্ছাচারী শাসকে পরিণত না হন তাঁর জন্য নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি স্বীকৃত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কাজ পরিচালনার ওপর কংগ্রেস প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে শাসন বিভাগীয় কর্মচারী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত সমূহের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেট সভার অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
তাছাড়া বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সন্ধি ও চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করবার জন্য রাষ্ট্রপতির সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। বাজেট প্রস্তাব, যুদ্ধবিষয়ক ক্ষমতা সম্পর্কে প্রস্তাব প্রভৃতির মাধ্যমে কংগ্রেস রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কংগ্রেস দ্বারা সীমাবদ্ধ। কংগ্রেস রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে; আবার কংগ্রেসকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রপতি কাজ করতে পারেন না।