রসিপুরম কৃষ্ণস্বামী নারায়ণ ছিলেন ইংরেজি ভাষায় বিখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প লেখক, যিনি আর. কে. নারায়ণ (R.K. Narayan) নামে পরিচিত, সাহিত্য জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বিখ্যাত। তিনি প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি সাহিত্যে এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি তাঁর অসংখ্য কাহিনী ও ঘটনার আলোকে ইংরেজি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এইক্ষেত্রে আর-এক বিশিষ্ট ভারতীয় লেখক মুলক রাজ আনন্দের মত তিনিও তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টিজগতে বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
আর. কে. নারায়ণ ১৯০৬ সালের ১০ই অক্টোবর তামিলনাডুর রসিপুরম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) এক খ্রীস্টান মিশনারী স্কুলে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেছিলেন। পরে তিনি মহারাজা কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন এবং সেই কলেজ থেকেই স্নাতক হন। সেই সময় তাঁর পিতা এক সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মাদ্রাজ শহর তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই শহর তাঁর মনে মানবিক সহৃদয়তা জাগিয়েছিল এবং প্রারম্ভিক চালিকাশক্তি দান করেছিল। তিনি জেনেছিলেন কিভাবে মানুষ সুখে ও দুঃখে উদাসীন থাকে এবং অশ্লীলতা সহ্য করে। স্নাতক হবার পর তিনি এই ঐতিহাসিক শহর ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে মহীশূরে বসবাস করতে থাকেন।
অন্যান্য অনেক লেখকের মত আর. কে. নারায়ণ লেখাকে তাঁর চাকরী হিসাবে গ্রহণ করেননি। পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সহজাত প্রতিভা এবং স্বাভাবিক বিচারবোধ শীর্ষে উন্নীত হবার জন্য নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। তার ফলে একজন সার্থক লেখক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই নব্বই-ঊর্ধ্ব লেখক নব্বই-এর দশকে চেন্নাইতে ফিরে যান এবং সেখানে আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে বাস করতে থাকেন।
আধুনিক ভারতের অপর এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দার্শনিক ও সমালোচক মুলক রাজ আনন্দের মত তিনিও সহজবুদ্ধির সাহায্যে তাঁর লেখায় মানুষের মন ও নৈতিকতাকে অনেক উপরে স্থান দিয়েছেন। যে অন্তর্দৃষ্টির বিশালতা তাঁর মধ্যে তাঁর বয়ঃসন্ধিতে জাগ্রত হয়, পূর্ণ কর্মশক্তি সম্পন্ন হয় ও পুষ্টিলাভ করে তা উজ্জ্বল বর্ণশোভিত হয়ে চতুর্দিকে সৌরভ ছড়ায়। তাঁর রচনার মাধুর্য ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। শীঘ্রই ইংরাজী ভাষায় একজন গল্পলেখক ও ঔপন্যাসিক হিসাবে সর্বত্র তিনি স্বীকৃতিলাভ করেন। তাঁর লেখার বিশেষ ধরন এবং তাঁর অস্পৃষ্ট দর্শন তাঁকে বিংশ শতাব্দীর মহান ইংরাজী লেখকদের মধ্যে অন্যতম দলে সম্মানিত করেছে। এই নব্বই-ঊর্ধ্ব লেখক একমাত্র ভারতীয় যিনি ইংরাজী ভাষায় ষাট বছরেরও বেশিদিন ধরে লিখে জীবনে সাফল্য অর্জন করেন। আজ পর্যন্ত তাঁর পনেরোটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প সংগ্রহ, ভ্রমণবিষয়ক দুটি গ্রন্থ এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর চারখানি রচনা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর ষোড়শ উপন্যাস রচনায় নিয়োজিত ছিলেন। এই গল্প বলিয়ে মানুষটি ছোটগল্পগুলিকে হাস্যরসাত্মক ও শ্লেষাত্মক করে তোলার পথ খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তার বিস্তার সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, চমৎকারিত্বে করা যায়।
বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রীনের সঙ্গ তাঁর সাহিত্যজীবনে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাব ফেলেছিল। তাঁদের এই বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় ১৯৩৫ সালে এবং পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের অল্পকাল পরেই। তাঁদের এই বন্ধুত্ব এত গভীর ছিল যে ১৯৯০ সালে গ্রাহামের মৃত্যু পর্যন্ত তা অটুট ছিল। তাঁদের এই বন্ধুত্ব উভয় লেখকের পক্ষেই হিতকর ছিল, বিশেষ করে আর. কে. নারায়ণের পক্ষে যার চিন্তাধারা বিশ্বব্যাপী সবিস্তারে ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে।
আর. কে. নারায়ণ তাঁর অতি সহজ কাহিনী ও চরিত্রসৃষ্টির জন্য পরিচিত যে চরিত্রগুলি সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ভারতীয়দের জীবন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তাঁর গল্পগুলি ‘মালগুডি’ নামক এক কাল্পনিক শহরকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। গল্পগুলি বর্ণনা করা হয়েছে প্রশান্ত বাস্তবতা এবং হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে। আর. কে. নারায়ণের লেখার মূল বিষয় অলৌকিক বা রহস্যময় নয়, আবার মোহাবিষ্ট চোখে দৃষ্ট অলীক ছায়ামূর্তি বিশিষ্ট নয়। তাঁর চিন্তাধারা স্বচ্ছ এবং সাধারণ জীবনের সাধারণ সমস্যাকেন্দ্রিক। তাঁর লেখার সম্ভাব্য ঘটনাগুলি বাস্তবভিত্তিক। তুচ্ছ এবং অর্থহীন বস্তু যা মানুষকে হতোদ্যম করে তোলে এবং মানুষের শান্তি বিপন্ন করে সেগুলি তাঁর ছোটগল্পে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সমাজের বিপর্যস্ত মানুষের কাহিনীর কথক হিসাবে তিনি নিঃসঙ্গ মানুষদের তুলে ধরেছেন এবং এখন থেকে তাদের অবস্থার উন্নতি করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি সরাসরি তাঁর বক্তব্য রেখেছেন; তিনি আলংকারিক বাহুল্য এবং বড় বড় শব্দপূর্ণ রচনাশৈলী এড়িয়ে গেছেন। অপরিহার্য নয় এমন চরিত্রগুলি তাঁর অকৃত্রিম সৃজনশীলতার ফলে আকর্ষণীয় চরিত্র বলে মনে হয় এবং অকারণ তুচ্ছতা সেখানে কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। তিনি অধিবাস্তববাদ বিরোধী ছিলেন এবং তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলিতে দলিত মানুষদের বিষণ্ণ মুখগুলিই কেবল তুলে ধরেননি, উপরন্তু ঘৃণ্য সক্রিয়তার উপরও আলোকপাত করেছেন।
সাহিত্য জগতে আর. কে. নারায়ণের সাফল্য বহুবিধ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি হিসাবে তিনি অনেক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন এবং উপাধি লাভ করেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘গাইড’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। এই বইটি ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি সিনেমায় চিত্রায়িত হয় এবং দেশব্যাপী জয়প্রিয়তা লাভ করে। তিনি জীবিতকালে রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার-এর সভ্যপদ লাভ করে আরেকটি বড় সম্মান পান। পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকা একাডেমী ও ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস্-এর অবৈতনিক সভ্য হন। তাঁর নব্বই বছর পূর্তি উপলক্ষে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই ডেজ’ (My Days) গ্রন্থটির একটি বিশেষ এবং সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি একটা খসড়া প্রকাশ করে। এই গ্রন্থটিকে এই প্রখ্যাত সৃষ্টিকারের জীবনের ধারাবাহিক ঘটনা বিবরণী বলা যেতে পারে। তাঁর জীবনী গ্রন্থ ফ্রন্টলাইন-এর সম্পাদক মিঃ এন, রাম এবং সুসান রাম কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থখানিতেও তাঁর জীবন, কর্মধারা, সাক্ষাৎকার এবং গ্রাহাম গ্রীনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের ধারাবাহিক বিবরণ রয়েছে। এই মহান লেখক ২০০১ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আর. কে. নারায়ণের রচনাবলী বিরাট ও বহুবিধ। ১৯৪৫ সালে তাঁর ‘Swami and Friends’ বইটি দিয়ে তাঁর প্রকাশনা শুরু হয়। পরে তিনি পনেরটি উপন্যাস এবং ছোটগল্পের কতকগুলি সংকলন প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দ্য ব্যাচেলর অব আর্টস’ (১৯৩৭), ‘দ্য ডা রুম’ (১৯৩৮), ‘অ্যান অ্যাস্ট্রলজার্স্ ডে অ্যান্ড’ আদা (র্) স্টোরিজ’ (১৯৪৭), ‘দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপার্ট’ (১৯৪৫), ‘দ্য গাইড’ (১৯৫৮), ‘দ্য ম্যান ইটার অব্ মালগুড়ি’ (১৯৬১), ‘দ্য ভেন্ডার অব্ সুইট্স’ (১৯৬৭), ‘আ হর্স্ অ্যান্ড টু গৌস্’ (১৯৭০) এবং ‘আ টাইগার ফ (র) মালগুড়ি’ (১৯৮৩)। তাঁর সমস্ত লেখাগুলি বিশেষভাবে ভারতীয় পরিমণ্ডলে রচিত এবং তাদের প্রেক্ষাপট হল একটি কাল্পনিক ছোট শহর মালগুড়ি। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দ্য মা(র) ট্যা(র) কর্ণার’, ‘দ্য এট’, ‘আউট অব্ বিজনেস্’ ‘স্নেইক ইন্ দ্য গার্ডেন’, ইত্যাদি।
তিনি তাঁর কাহিনীর বিষয়বস্তুর জন্যই বস্তবতাকেই অনুসন্ধান করেছেন কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা যে তিনি মাদ্রাজ, মহীশূর প্রভৃতি শহর দ্বারা প্রভাবিত জেলাগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত নাগরিকদের মনোভাব ও আচরণ নিয়ে গল্পগুলি লিখেছেন। তাঁর অধিকাংশ গল্প আঞ্চলিকতার সৌরভে সুরভিত ও তাতে আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব থাকায় সেগুলি বাস্তবধর্মী হয়ে উঠেছে। তাঁর যে গল্পগুলি দক্ষিণ ভারতের কাল্পনিক শহর মালগুড়ি সম্বন্ধে লেখা সেগুলি টেলিভিশন সিরিয়াল করে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে।