শিক্ষাকে আজ অনেকেই সমাজ-সংরক্ষণের অপরিহার্য উপকরণ ও সমাজ প্রগতির উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে চিত্রিত করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা যেমন শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে ব্যক্তির অস্তিত্ব অটুট রাখার বিষয়টুকু বিবেচনা করেছেন, সমাজবিজ্ঞানীরাও তেমন সমাজ-সংরক্ষণ, সামাজিক বিকাশ ও সমাজ-প্রগতিকে শিক্ষার লক্ষ্য ভেবেছেন।
সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা ও সামাজিক বিকাশ যদি শিক্ষার লক্ষ্য হয় তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সমাজের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিচর্যা করতে হয়। এই পরিচর্যা ছাড়া কোন সমাজই সম্মানের সঙ্গে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয় না।
আবার এই পরিচর্যা বলতে যা বোঝানো হয় তা হচ্ছে কোন সমাজের বয়স্কদের মধ্যে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি, সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান, চিন্তা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রভৃতির ভাণ্ডারটিকে আগামীদিনের সন্তান-সন্ততিদের হাতে তুলে দেওয়া।
বস্তুত এই পরিচর্যাটুকু ছাড়া কোন বিশেষ সমাজের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না বলে অনেক সমাজবিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ বলেন যে সমাজের বর্তমান সভ্যদের হাত থেকে ভবিষ্যৎ সভ্যদের হাতে সঞ্চিত ভাবধারা ও ঐতিহ্যের সঞ্চারণ প্রক্রিয়াই হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য।
শিক্ষার এই সমাজ-সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রাচীনরা তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য আগামী দিনের বংশধরদের জন্য রেখে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং সমাজের নিরবচ্ছিন্নতা সম্ভবপর করে তোলে। মূলত এক যুগের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতাকে অন্য যুগে পরিবাহিত করে বিশেষ যুগের মানবগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়।
এদিক থেকেই অনেক শিক্ষাবিদ সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক মানবগোষ্ঠী থেকে ভবিষ্যতের অন্য গোষ্ঠীতে সামাজিক উত্তরাধিকারদের সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে শিক্ষার লক্ষ্য বলেছেন। বস্তুত এই সামাজিক উত্তরাধিকারের সঞ্চালনের মধ্যে দিয়েই শিক্ষা সমাজ-উন্নয়ন ও সমাজ-প্রগতির পথকে কণ্টকমুক্ত করে তোলে এবং সমাজতত্ত্বমূলক ভিত্তিকে গুরুত্ব দেয়।
তাই সমাজের অস্তিত্ব রক্ষাই কেবল শিক্ষার লক্ষ্য হতে পারে না। সমাজকে এগিয়ে যাওয়ার ধ্যানে, ভাবে ও কাজে উদ্বুদ্ধ করে গতিশীল রাখাও শিক্ষার লক্ষ্য। এইজন্য শিক্ষার লক্ষ্য হবে সমাজের প্রগতি আনা এবং নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা। শিক্ষার দ্বারা তাই নতুন তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কারের এবং নতুন কৌশল ও জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটিকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজন আছে। স্থানু সমাজকে চলমান পৃথিবীর পাশে সত্যই খুব বেমানান লাগে।
শিক্ষার লক্ষ্য যদি কেবল সমাজকে রক্ষা করা হয় তাহলে সমাজ তার গতিশীলতাকে হারিয়ে ফেলে ও প্রাণশক্তি খুঁজে পায় না। তাই সমাজের প্রাণশক্তি, সামাজিক বিকাশ ও গতিশীলতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে শিক্ষাকে কেবল সমাজ-সংরক্ষণমূলক কাজ করলে চলবে না-সামাজিক বিকাশের অনুকূলে সমাজ-প্রগতিমূলক কাজও করতে হবে।
একমাত্র এতেই কোন সমাজ প্রাণিন, গতিশীল ও সম্পদশীল হয়ে উঠতে পারে এবং এর মধ্য দিয়েই শিক্ষায় সমাজতত্ত্বমূলক তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিকে পরিশীলিত পথে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
শিক্ষার লক্ষ্য কেবল সমাজ-সংরক্ষণই নয়-সমাজের অগ্রগতি বা প্রগতিও। এই পটভূমিতে অনেকে আবার শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচনা করে থাকেন। সমাজ পরিবর্তনে যেমন শিক্ষাকে পরিবর্তন করতে হয় তেমন শিক্ষাকে আবার সমাজের পরিবর্তনের জন্যও কাজে লাগানো হয়ে থাকে।